বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৩৪৭ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। চিত্তরঞ্জন দত্ত, বীর উত্তম দক্ষ এক সেক্টর অধিনায়ক ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে ৪ নম্বর সেক্টর ছিল গুরুত্বপূর্ণ এক এলাকা। এই সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন চিত্তরঞ্জন দত্ত। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিরাট অংশ নিয়ে ছিল এই সেক্টর।

অধীন এলাকাগুলো হলো সিলেট জেলার কানাইঘাট, জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জ ও বিশ্বনাথ উপজেলা, সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর, দিরাই, শাল্লা উপজেলা এবং মৌলভীবাজার জেলা।
৪ নম্বর সেক্টরের বিভিন্ন স্থানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল তাদের পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, বালুচ রেজিমেন্ট, ফ্রন্টিয়ার ফোর্সসহ বিভিন্ন সেনা ইউনিট। সহযোগী হিসেবে ছিল খাইবার রাইফেলস, মুজাহিদ ব্যাটালিয়ন, তোচি স্কাউটস ও থাল স্কাউটস। এ ছাড়া ছিল বিভিন্ন গোলন্দাজ দল।
সেক্টরের অধিনায়ককে সাধারণত মুক্তিবাহিনীর কেন্দ্রীয় কমান্ডের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে যুদ্ধ পরিচালনা করতে হতো। পাশাপাশি সাব সেক্টরগুলোর আহ্বান সুদৃঢ় করা, দেশের ভেতর গেরিলা তৎপরতা অব্যাহত রাখা। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ সরবরাহ প্রভৃতি। এ কাজগুলো চিত্তরঞ্জন দত্ত দক্ষতার সঙ্গে পালন করেন।
৪ নম্বর সেক্টর এলাকায় অসংখ্য যুদ্ধ সংঘটিত হয়। বেশ কয়েকটি যুদ্ধে চিত্তরঞ্জন দত্ত নিজেই নেতৃত্ব দেন। সেক্টর গঠিত হওয়ার পর চিত্তরঞ্জন দত্তের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা প্রথম দিকের দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠে। ছাত্র-জনতা-কৃষক-শ্রমিক এবং ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ সমন্বয়ে গড়ে ওঠা মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে সুপরিকল্পিতভাবে অনেকগুলো অপারেশন করেন। চিত্তরঞ্জন দত্তের একটি বয়ান আছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ, দলিলপত্র, দশম খণ্ডে। বয়ানে তাঁর সেক্টরের অনেক যুদ্ধের বর্ণনা আছে। একটি যুদ্ধের কথা শোনা যাক সেই বয়ান থেকে।
‘...খাওয়া-দাওয়া করে গ্রাম থেকে দুজন গাইড নিয়ে চললাম হিমুর উদ্দেশে। সারা রাত নদী-খাল-বিল পার হয়ে পৌঁছলাম আটগ্রাম বলে একটি গ্রামে। সেখান থেকে হিমুর দূরত্ব দুই মাইল। আটগ্রামে পৌঁছলাম ভোর চারটায়। গ্রামের পাশে নদী পার হতে হবে। ওপারে সবাই পৌঁছলাম। সকাল হতে চলেছে। দেখলাম হিমু পর্যন্ত পুরো মাঠ খোলা। চিন্তা করলাম দিনের বেলা এই খোলা মাঠের ভেতর দিয়ে যাওয়া সমীচীন হবে না।
‘যা-ই হোক আমরা সবাই আবার নদী পার হয়ে আটগ্রামে ফিরে এলাম। বেলা সাড়ে আটটা হবে। পাকিস্তানিদের দিক থেকে শুরু হলো গোলাবর্ষণ। একই সঙ্গে মেশিনগান ও এসএমজির গুলিবর্ষণ। কিছু করার নেই, একেবারে শত্রুর মুখে পড়ে গেছি। আটগ্রাম ছোট গ্রাম। বৃষ্টির মতো গোলাগুলি হচ্ছিল। চিন্তা করলাম যদি আটগ্রামে থাকি সবাই মারা যাব। তাই সবাইকে বললাম, যে যেভাবে পারে পেছনে যেতে।’ পৃষ্ঠা: ৩৪৭-৪৮। পরে সেখানে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। চিত্তরঞ্জন দত্ত অত্যন্ত ধৈর্য্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করেন। তাঁর প্রেরণায় মুক্তিযোদ্ধারা যথেষ্ট সাহস ও বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন।
চিত্তরঞ্জন দত্ত চাকরি করতেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ফ্রন্টিয়ার ফোর্সে। ১৯৭১ সালে ছুটিতে বাড়িতে ছিলেন। তখন তাঁর পদবি ছিল মেজর। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। হবিগঞ্জ-মৌলভীবাজারে প্রতিরোধযুদ্ধ করেন। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান। পরে তিনি ৪ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক নিযুক্ত হন।
মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য কৃতিত্ব ও অবদানের জন্য চিত্তরঞ্জন দত্তকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৪। তিনি সি আর দত্ত নামে বেশি পরিচিত।
চিত্তরঞ্জন দত্তের পৈতৃক বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার মিরাশি গ্রামে। বর্তমান ঠিকানা বাসা-৪৯, সড়ক-২, পুরোনো ডিওএইচএস, বনানী, ঢাকা। স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। মেজর জেনারেল পদ থেকে অবসর নেন। তাঁর বাবা উপেন্দ্রচন্দ্র দত্ত। মা লাবণ্য প্রভা দত্ত, স্ত্রী মনিষা দত্ত। তাঁর এক ছেলে, তিন মেয়ে।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.