সপ্তাহের হালচাল-বিএনপি কোন পথে যাবে? by আব্দুল কাইয়ুম

বিএনপির সামনে দুটি পথ—কঠোর কর্মসূচির ধারায় এগিয়ে যাওয়া; অথবা আন্দোলনের কর্মসূচি রেখেও অনুকূল শর্তে আলোচনায় বসা, সংসদে যাওয়া। কোনটা ভালো, বিএনপিকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সবাই ধরে নিয়েছিল, আরাফাত রহমান কোকোর দুর্নীতির মামলায় জেল-জরিমানা হলে বিএনপি রবি-সোমবার দুই দিনের, না হলে অন্তত এক দিনের

হরতাল ডাকবে। কিন্তু ছয় বছরের জেল ও প্রায় সাড়ে ১৯ কোটি টাকা জরিমানা করা হলেও বিএনপি হরতাল ডাকেনি। পরিবর্তে বিক্ষোভের কর্মসূচি নিয়েছে। হঠাৎ হরতাল যেমন নাগরিকদের সচকিত করে, তেমনি আবার হারতাল না করার মধ্যেও বিশেষ রাজনৈতিক তাৎপর্য থাকে। এবার হরতাল না ডাকা বিএনপির রাজনীতিতে বাস্তবতা বিবেচনায় নেওয়ার ইঙ্গিত বহন করে।
এখানে বিরাজমান বাস্তবতার অন্তত একটি বিষয়ে বিএনপি দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে। কোকোর অর্থ পাচারের মামলার রায় নিয়ে বেশি কিছু করতে যায়নি। কারণ এই দুর্নীতির বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের আগে আমেরিকার আদালতে একটি রায় হয়েছে। সিমেন্স কোম্পানি কোকোসহ বাংলাদেশের কিছু সরকারি কর্মকর্তাকে যে ঘুষ দিয়েছিল, তা আমেরিকার আদালতে প্রমাণিত হয়। সিঙ্গাপুরের একজন ব্যবসায়ীকেও সেখানকার আদালত জরিমানা করেন। সুতরাং অর্থ পাচারের বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্যভাবে বিদেশের আদালতে প্রমাণিত হয়েছে। এখন বিএনপি যে দাবি করছে, এই মামলার রায় সাজানো, তা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা কঠিন। তাই তেতো বড়িটি গলাধঃকরণ করা শ্রেয় বলে মনে করে থাকলে বিএনপি সুবুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে বলে ধরে নিতে হবে।
অবশ্য বিএনপি হরতালের রাজনীতি বিসর্জন দিচ্ছে না। বরং আরও জোরেশোরে হরতাল করার প্রস্তুতির জন্যই এবার হরতাল ডাকেনি। ৩ জুলাই কঠোর কর্মসূচি ঘোষণার কথা। এর আগে ২১ জুন মঙ্গলবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় হরতাল, লংমার্চ প্রভৃতি কর্মসূচি নিয়ে কথা হলেও নিজেদের দল গোছানোর প্রতি তারা বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছে। এ বিষয়ে তখন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাঁরা জেলা সফরে যাচ্ছেন। তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের উজ্জীবিত করে আগামী দিনে হরতাল ও অন্যান্য কর্মসূচিসহ শক্তিশালী আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
সরকারের অনেক কাজে মানুষ হতাশ। জিনিসপত্রের দাম, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, রাজধানীতে দিনদুপুরে ডাকাতি, সরকারদলীয় ক্যাডারদের চাঁদাবাজিসহ কিছু ঘটনায় মানুষের মধ্যে সরকার সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব দানা বাঁধতে শুরু করেছে। মানুষ সরকার সম্পর্কে যত হতাশ হবে, পরবর্তী নির্বাচনে বিরোধী দলের ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা ততই উজ্জ্বল হবে। বিএনপির কর্মীরা ভয়ভীতি উপেক্ষা করে মাঠে নেমে পড়বেন। এ ব্যাপারে তাঁদের প্রেরণা জোগাবেন বিএনপির আগামী নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থীরা। পরবর্তী নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার আশায় তাঁরাই কর্মীদের জড়ো করে আন্দোলনের মাঠ গরম করবেন। এর জন্য কিছু সময় লাগবে।
যদিও প্রায় আড়াই বছর বাকি, তাও বলব, এখন বিএনপির একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হওয়া উচিত নির্বাচন। কোনো রকম অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির দিকে না গিয়ে কীভাবে নির্বাচনের দিকে যাওয়া যায়, সেটাই বিএনপির জন্য এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হলে ভালো। স্লোগান হিসেবে তারা সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা বা মধ্যবর্তী নির্বাচনের কথা বলতে পারে, কিন্তু লক্ষ্য হতে হবে মেয়াদ শেষে নির্বাচন।
বিএনপির চেয়ারপারসন আন্দোলনের এই কৌশলটি ঠিক ধরতে পেরেছেন বলেই তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করতে তাঁদের প্রস্তুতির কথা জানিয়েছেন। সরকার সংবিধান সংশোধনী বিলে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের প্রস্তাব করলেও আদালতের পর্যবেক্ষণ অনুসারে আগামী দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে তাদের আপত্তি নেই বলে বিভিন্ন সময়ে জানিয়েছে। সরকারদলীয় একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। আবার বিএনপিও আগামী দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে রাজি।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, তাঁর উপজেলার নয়টি ইউনিয়নের সব কটিতেই বিএনপির সমর্থক নেতারা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি বলেন, হাওয়া ঘুরে যাচ্ছে, সরকারের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ছে। এ অবস্থায় দুই পক্ষের মধ্যে সংলাপ হওয়া উচিত। না হলে দেশে রাজনৈতিক অরাজকতা সৃষ্টি হবে বলে তিনি মনে করেন। এ ব্যাপারে সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে। আবার বিএনপিকেও সংসদে যেতে হবে।
নির্বাচনের রায় বল প্রয়োগে সরকারের পক্ষে নিয়ে যাওয়া এখন ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে। না হলে উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে এত বেশি বিএনপি-সমর্থক প্রার্থী জয়লাভ করেন কীভাবে? এর আগে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী মহিউদ্দিন চৌধুরী পরাজিত হয়েছেন। এখন আলোচনার মাধ্যমে যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে বিএনপির লাভ ষোলোআনা।
কিন্তু বিএনপির কিছু নেতা রাজনীতির অন্তর্নিহিত গতিপ্রকৃতির বিষয়ে মনোযোগী না হয়েই বিভ্রান্তিকর কথা বলে চলেছেন। যেমন, সংবিধানের প্রস্তাবিত সংশোধনীর বিষয়ে এক সেমিনারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ কোনো আলোচনার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলে সংবিধানে কোনো কিছু নেই, তাই এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনার কোনো কারণ নেই। ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ নামক একটা ছুতো তুলে তিনি কার্যত আলোচনার বিরুদ্ধে নেমেছেন। নাম যা-ই দেওয়া হোক, বিষয়টা যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সে তো সবাই জানেন। অবশ্য এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার বলেছেন, সরকারের সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে তাঁরা আলোচনা করতে প্রস্তুত। এ ব্যাপারে বিএনপির চেয়ারপারসন প্রেস ব্রিফিংয়ে দলের অবস্থান পরিষ্কারভাবে জানিয়েছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন (দি ইনডিপেনডেন্ট, ২৫ জুন, ২০১১)। তাহলে মওদুদ আহমদ উল্টাপাল্টা বলছেন কেন? তিনি কী চান?
এর আগে একটি চ্যানেলের টক শোতে বিএনপির নেতা নাজমুল হুদা বলেন, পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের এখতিয়ার নাকি আদালতের নেই। সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো আইন যদিও আদালত বাতিল করতে পারেন, কিন্তু সেই আইন যদি সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়, তাহলে নাকি আদালত তা আর সংশোধন করতে পারেন না। তাঁর মতে, তখন নাকি সেটা পারে কেবল সংসদ। এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আদালত সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো আইন বাতিল করতে পারেন। এ প্রসঙ্গে তিনি ভারতের সুপ্রিম কোর্টের একটি ঐতিহাসিক রায়ের উল্লেখ করেন। ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী একবার সংবিধান প্রদত্ত সুপ্রিম কোর্টের রিভিউ পাওয়ার বাতিল করলে ১২ জন বিচারক রায় দেন, ‘ক্রিয়েটার ক্যান্ট বি ডেস্ট্রয়েড বাই ক্রিয়েশন’ (অস্তিত্বলাভকারী তার অস্তিত্বদানকারীকে ধ্বংস করতে পারে না)। যেহেতু সংসদ সংবিধানের বিধানাবলি অনুযায়ী গঠিত, তাই সংসদে এমন কোনো আইন প্রণীত হতে পারে না, যা সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থী।
ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার কথার অর্থ দাঁড়ায়, আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হতে পারে না, তাই এ ব্যাপারে আলোচনার সুযোগ নেই। এই ব্যারিস্টাররা বিএনপিকে কানাগলির দিকে ঠেলে দিচ্ছেন।
আবার কেউ কেউ এক-এগারোর জুজুর ভয় দেখিয়ে বলছেন, ওঁরা নাকি আসছেন! যেখানে পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের মাধ্যমে অশুভ শক্তির ক্ষমতা দখলের পথ বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তখন ওই সব কথা বলার উদ্দেশ্য পরিষ্কার। এ ব্যাপারে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহেদুল আনাম খানকে জিজ্ঞেস করলে তিনি আইয়ুব, ইয়াহিয়া, জিয়া, এরশাদের ক্ষমতারোহণের কালপঞ্জি উল্লেখ করে বলেন, অন্তত ১০ বছরের আগে সে রকম আশঙ্কা নেই। নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের ছাড়া অন্য কারও শাসন যে এ দেশে চলবে না, তাতে কারও সন্দেহ থাকা উচিত নয়।
একটা সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে একযোগে কাজ করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.