সময়ের কথা-সকালের শতচ্ছিন্ন কাঁথায় বিকেলে জোড়াতালি by অজয় দাশগুপ্ত

ঢাকা থেকে বরিশালগামী পারাবাত-১১ লঞ্চটিতে যে বালকটি ভুট্টার খই বিক্রি করতে এসেছিল, নাম তার চাঁন। বাবার নাম চান্দ। কেবিনে আমার সহযাত্রী দেখাচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেড়শ'তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি স্মারক মুদ্রা। রুপার তৈরি এ মুদ্রায় যেন হীরকের দ্যুতি।

কবির ছবিটিও আমাদের চেনা। ভুট্টার খই বিক্রি করতে আসা ছেলেটি একাগ্রচিত্তে তাকিয়ে ছিল মুদ্রাটির দিকে। সহযাত্রী তাকে বললেন, 'এ ছবিটি কার বলতে পারলে তোর কাছ থেকে ভুট্টা কিনব।' আমাদের অবাক করে দিয়ে চাঁনের উত্তর : 'রবি ঠাকুর।'
প্রশ্ন করি : 'কীভাবে চিনলি?' উত্তর : 'স্কুলের বইয়ে দেখেছি।'
'কোন ক্লাসে পড়িস?'
'এখন পড়ি না। আগে পড়েছি, তখন বইয়ে দেখেছি। এখন লঞ্চে খাবারের দোকানে কাজ করি।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের যারা মুদ্রাটি তৈরির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং যে শিল্পী নকশা করেছেন তাদের জন্য সন্তুষ্টির কারণ হচ্ছে, সামান্য লেখাপড়া জানা এক বালকও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চিনতে পেরেছে।
পরদিন ১৮ আগস্ট সকালে বরিশাল শহর থেকে যাই গৌরনদী হয়ে আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলায়। লঞ্চ ছেড়ে উঠেছি একটি মাইক্রোবাসে। ঢাকা-বরিশাল সড়কের বরিশাল-গৌরনদী অংশে (৩৫ কিলোমিটার) কেবল শিকারপুর-দোয়ারিকা দুটি সেতুর দুই পাশের কয়েক কিলোমিটার বাদে (এ অংশটি একটি বিদেশি কোম্পানি নির্মাণ করেছে) প্রায় পুরোটাই যানবাহন চলাচলের অনুপযুক্ত। গত কয়েক বছরে এ পথে সংস্কারের আঁচড় লাগেনি। কিন্তু বিকেল ৬টার দিকে এ পথ ধরেই গৌরনদী থেকে যখন বরিশাল শহরে ফিরছি, অবাক বিস্ময়ে দেখলাম কিছু কিছু গর্ত-খানাখন্দে বালি ও নিম্নমানের ইটের খোয়া ফেলে ভরাট করা হয়েছে। শতচ্ছিন্ন কাঁথায় জোড়াতালি দিলে তা যেমন হয় ক্ষণস্থায়ী, এ সড়কের নিম্নমানের 'সংস্কারের' পরিণতিও তেমনই হবে, তাতে সন্দেহ নেই। যারা এ কাজের ঠিকাদারি পেয়েছে, তাদের বরাত ভালো বলতেই হয়। তারাও যুক্তি দেবে_ কাজ তো ঠিকই করেছি। বৃষ্টি এসে ধুয়ে নিয়ে গেলে কী করার আছে? ১৮ আগস্ট রাতে একই লঞ্চে ঢাকা ফিরি। ফেরার সময় কেবিনে দেখা গেল, এয়ারকন্ডিশন মেশিন অচল। কিন্তু তাতে ভাড়ার পরিমাণ একটুও কমানো হলো না। লঞ্চ ঢাকার কাছাকাছি আসার সময় দেখা গেল, একদল বালক ও কিশোর কেবিনে কেবিনে ঘুরে বোতলজাত পানির খালি বোতল সংগ্রহ করছে। এগুলো তারা বিভিন্ন কোম্পানির কাছে দুই টাকা করে বিক্রি করে। ওই কোম্পানিগুলো তাতে 'বিশুদ্ধ ফিল্টারড পানির নামে ওয়াসার পানি ভরে' বিক্রি করে ১৫-২০ টাকায়। আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চেনা চাঁনই জানাল এ গোপন রহস্য। তার ভাষ্য : 'খারাপ পানি ফেরেশ কইয়া বেচে।'
কোথাও কেউ নেই যে দেখার!
১৯ আগস্ট সকালে ঢাকা ফিরে সংবাদপত্রে দেখলাম নৌ পরিবহনমন্ত্রীর (যিনি একইসঙ্গে সড়ক পরিবহন শ্রমিকদের নেতা) বক্তব্য : ট্রাক-বাস চালানোর লাইসেন্স পেতে আনুষ্ঠানিক পড়াশোনার দরকার নেই_ ছবি দেখে সড়কের নির্দেশনা বুঝতে পারলেই হলো। তিনি অজ্ঞানতার পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। সত্যিই তো, রবীন্দ্রনাথ যদি স্কুল-কলেজ পাস না দিয়েই নোবেল পুরস্কার পেতে পারেন, বিলাতে গিয়ে সাহেবদের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন, তাহলে লেখাপড়া না শিখেও গাড়ি চালাতে সমস্যা হবে কেন? আসুন, আমরা সবাই 'সবার জন্য শিক্ষা' স্লোগান লেখা সব ব্যানার ও পোস্টার পুড়িয়ে ফেলি এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় তুলে দিই। আর সবার আগে ভেঙে চুরমার করে দিই সব বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র। এসব কাজে কেন যে অর্থের অপচয় করা হচ্ছে! এভাবে বেঁচে যাওয়া অর্থের একটি অংশ নৌ পরিবহনমন্ত্রীকে কনসালট্যান্সি ফি হিসেবে দেওয়া যেতেই পারে।
আজ ২১ আগস্ট। ২০০৪ সালের এ দিনের শেষে গৌরনদী হয়ে ঢাকা ফিরছিলাম সড়ক পথে। সন্ধ্যার পর পর গাবতলীর কাছাকাছি এলে বাসে পাশের সহযাত্রী জানালেন সেই ভয়ঙ্কর খবর : বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে শেখ হাসিনার সভায় বোমা হামলা হয়েছে। শেখ হাসিনা বেঁচে আছেন কি-না বলতে পারেননি ওই সংবাদদাতা।
খবরটি শুনে আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল : মুজিবের পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার খেসারত আর কতভাবে না দিতে হবে! বঙ্গবন্ধু পরিবারের দু'জন বাদে সব সদস্যকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এবার টার্গেট করা হলো শেখ হাসিনাসহ পুরো আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার কয়েকজন সহকর্মীকে হত্যা করা হয়। জেলখানায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদসহ জাতীয় চার নেতাকে হত্যা এবং শত শত নেতাকে কারারুদ্ধ করার উদ্দেশ্যও ছিল আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করা। এরপর প্রায় তিন দশকের চেষ্টায় শেখ হাসিনাকে কেন্দ্র করে যে নতুন নেতৃত্ব দাঁড়ায় তাদের নিশ্চিহ্ন করার জন্যই পরিচালিত হয় ২১ আগস্টের (২০০৪) গ্রেনেড হামলা। সে সময় ক্ষমতাসীন ছিল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর জোট সরকার। প্রকাশ্য দিবালোকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে সামরিক কায়দায় পরিচালিত এত বড় অভিযান সম্পর্কে ক্ষমতাসীনদের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক ব্যক্তি জড়িত ছিল না, এটা হওয়া সম্ভব নয়। তবে বিএনপি নেতৃত্ব দ্রুতই চেষ্টা করে, এ অভিযানের দায়িত্ব আওয়ামী লীগের ওপর চাপিয়ে দিতে। তাদের ভাষ্য ছিল এ রকম :১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যেমন ছিল খোন্দকার মোশতাক, এবারও আওয়ামী লীগের কিছু লোক এ হামলা সংঘটিত করেছে। সেই ভয়ঙ্কর বিকেলে আওয়ামী লীগের যেসব নেতা ট্রাকে তৈরি করা অস্থায়ী মঞ্চে ছিলেন না, তাদের দায়ী করে বিএনপি দেশব্যাপী লাখ লাখ রঙিন পোস্টার লাগায়। শেখ হাসিনাকে সমবেদনা জানাতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সুধা সদনে যেতে চান, এ খবরও নানাভাবে প্রচার করা হতে থাকে। এটা কি নিজেদের আড়াল করার চেষ্টা ছিল?
২০০৫ সালের ১৭ আগস্টেও ছিলাম ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে। দুপুরে ঢাকা পেঁৗছেই দেখি সর্বত্র দারুণ উৎকণ্ঠা_ দেশের সর্বত্র শত শত স্থানে বোমা-গ্রেনেড হামলা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে স্পষ্ট হয় যে, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই এবং শায়খ আবদুর রহমানের জেএমবির কাজ ছিল এটা। ইসলামী বিপ্লব সম্পন্ন করার প্রথম ধাপ ছিল এটা। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব এ গোষ্ঠীর তৎপরতা অবশ্যই জানত। এর দায় আওয়ামী লীগের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার লক্ষ্য সামনে রেখে তাদের জেলা পর্যায়ের নেতাদের একটি অংশকে গ্রেফতারের সিদ্ধান্তও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর নিয়েছিলেন বলে জানা যায়। তবে আওয়ামী লীগের জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে 'সাতক্ষীরার পকেটমার রওশন'। পেশায় সে ছিল আদপেই পকেটমার। ২১ আগস্ট সে গিয়েছিল সাতক্ষীরা পুরাতন কোর্ট এলাকায় 'পেশাগত দায়িত্ব' পালনে। সে দেখতে পায় তার প্রতিবেশী নাসিরউদ্দিন দফাদার আদালত এলাকায় একটি ব্যাগ রেখে কিছুদূর চলে যেতেই তাতে বিস্ফোরণ ঘটে। রওশন নিশ্চিত হয় যে, নাসিরউদ্দিন দফাদারই এ কাজ করেছে এবং বিষয়টি সে সাতক্ষীরার সাংবাদিক আনিসুর রহিমকে জানায়। আনিস সাহেব সেটা জানান স্থানীয় থানা ও এনএসআইয়ের কয়েকজনকে। তারা নাসিরউদ্দিনকে আটক করে দ্রুতই জেনে যান যে, ধর্মান্ধ একটি গোষ্ঠীর প্ররোচনায় সে এ কাজ করেছে। নাসিরউদ্দিনের সাক্ষাৎকার পরদিন প্রচারিত হয় এটিএন বাংলায়। কেন আটক নাসিরউদ্দিনের সচিত্র বক্তব্য এটিএন সাংবাদিককে নিতে দেওয়া হলো সে অভিযোগে ওসির চাকরি যায় বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের ভয়ঙ্কর ক্ষোভে। তবে 'পকেটমার রওশন' সবচেয়ে বড় উপকার করেছে আওয়ামী লীগের_ তাদের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের অনেক নেতাকেই ১৭ আগস্ট (২০০৫) একযোগে ৬৩ জেলায় বোমা হামলা পরিচালনার দায়ে গ্রেফতার করার পরিকল্পনা যে চূড়ান্ত ছিল! তাদের এ চেষ্টা সফল হলে আরও অনেক মাস নির্বিঘ্নে কাজ চালিয়ে যেতে পারত হুজি-জেএমবি এবং এ ধরনের অপশক্তি।
২১ আগস্টের (২০০৪) ঘটনার পরপরই যদি বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী নেতৃত্ব 'জজ মিয়া' উপাখ্যান তৈরির পরিবর্তে প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করায় মনোযোগী হতো, তাহলে হয়তো ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা হামলা হতো না। পরের কয়েকটি মাস দেশের আরও কয়েকটি জেলাও আত্মঘাতী বোমাবাজদের হামলায় নরককুণ্ডে পরিণত হতো না। এ ধরনেরই একটি হামলা হয়েছিল নেত্রকোনা জেলায় ৮ ডিসেম্বর (২০০৫)। নিহতদের একজনের নাম যাদব দাস_ পেশায় মোটর মেকানিক। বাবর সাহেব মুহূর্ত দেরি না করে বললেন, 'যাদব দাসই আত্মঘাতী হামলাকারী। অতএব, নতুন ডাইমেনশন'। তার স্পষ্ট ইঙ্গিত :'একজন হিন্দু যেহেতু হামলা চালিয়েছে, তাই দেশব্যাপী ১৭ আগস্টের বোমা হামলা ও পরবর্তী আত্মঘাতী হামলার পেছনে আওয়ামী লীগ রয়েছে এবং কান টানলে যেমন মাথা আসে, তেমনই রয়েছে ভারত! প্রকৃতপক্ষে যাদব দাস নিহত হয়েছিল ঘটনাস্থল দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাওয়ার সময়। বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী নেতৃত্ব যে শতচ্ছিন্ন কাঁথা নরম সুতা দিয়ে জোড়াতালি দিতে চেয়েছিল! এটা কি কেবলই গদি আঁকড়ে থাকার জন্য, নাকি বিরোধটা আদর্শেরও?

অজয় দাশগুপ্ত :সাংবাদিক
 

No comments

Powered by Blogger.