মুক্তিযুদ্ধের ছবিতে ববিতা by কামরুজ্জামান

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বেশ কিছু আলোচিত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন ববিতা। বর্তমানে তিনি আছেন কানাডায়। স্বাধীনতা অর্জনের এই মাসে তাঁর কাছে আমরা জানতে চাইলাম সেই ছবিগুলোর কথা। সে কথার ফাঁকেই উঠে এল একাত্তর।ত
ফোনালাপ
দুই বোন সুচন্দা ও চম্পা আগেই চলে গিয়েছিলেন আমেরিকায়। ববিতাও সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি বোনদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াবেন। আর সময় পেলেই ছেলে অনীকের কাছে যাবেন কানাডায়।
গত সোমবার যখন ববিতার মুঠোফোনে ফোন করা হলো, তখন কানাডায় গভীর রাত। একবার-দুবার-তিনবার—ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে শুধু মেসেজ বক্সের রেকর্ডেড ভয়েস শোনা গেল।
চারবারের সময় ফোনটি ধরলেন ববিতা।
কুশলাদিপর্ব শেষ করে ফোন করার হেতু জানালাম।

প্রসঙ্গ ‘লেট দেয়ার বি লাইট’
লেট দেয়ার বি লাইট-এর শুটিং হয়েছিল যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই। ছবি যখন হয়, তখন অলিভিয়াকে সাইন করানো হয়েছিল। স্বাধীনের পর এ ছবির বাকি অংশের শুটিং হবে—এমনটি জানি আমরা। এ ছবিতে আমি একজন বিদেশি খ্রিষ্টান মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করি। খাটো স্কার্ট পরা। ববছাঁট চুল। বাচ্চা ছেলেমেয়ের প্রেম। ২ নম্বর ফ্লোরের পেছনে। সেখানে দেখা গেল, অসংখ্য গ্লাস ভাঙা ঘরের ভেতর। সেই ভাঙা গ্লাসের ভেতর দিয়ে আমাকে আমার সম্ভ্রম বাঁচানোর জন্য দৌড়ে আসতে হবে। জহির ভাই আমাকে বললেন, ‘পপি (আমার ডাকনাম পপি), তুমি কেমন, তা আজকে অভিনয় করে দেখাও। ওই ঘর থেকে এই ঘরে কাচের ওপর দিয়ে দৌড়ে তোমাকে পালাতে হবে।’ আমি এতই আবেগতাড়িত হয়ে গেলাম, সেই কাচের ওপর ‘মা’ বলে একটা চিৎকার করে দৌড়ে আসি। পড়ে গেলাম। হাত-পা কেটে গেল, রক্ত বেরোল। দৃশ্যটি এত সুন্দর হয়েছিল, তা বোঝানোর মতো ভাষা আমার নেই। এ ছবি যদি কোনো দিন মুক্তি পেত, কী যে হতো! তাঁরা অলিভিয়াকে ছবিতে সাইন করিয়ে নিলেও জহির ভাই মনে করলেন, এখানে ববিতাকেই বেশি ভালো লাগবে।
জহির ভাইয়ের ইচ্ছা ছিল, ছবিটি তিনি দেশে ও দেশের বাইরে রিলিজ দেবেন। সব ছবির তিনি স্ক্রিপ্ট করেন, কিন্তু এ ছবির লিখিত কোনো স্ক্রিপ্ট করেননি। এর সবকিছু তাঁর মাথায় আছে। লাইট করলেন, নিজে ক্যামেরা চালালেন। তিনিই সবকিছু করলেন। ৮০ শতাংশ কাজ হয়ে গেছে। পরে এ ছবির সেই দৃশ্য নিয়ে অনেক লেখক-পরিচালক (আমি নাম বলব না) বিভিন্ন ছবিতে ব্যবহার করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা
ডাক পেলাম সুভাষদার অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী ছবির জন্য।
অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী: আমাদের শুটিং হবে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে। গল্পটা জানা—এক গ্রামের সাধারণ একটি মেয়ের সাধারণ একটি ছেলের সঙ্গে প্রেম। মেয়েটির সামনে পরিবারের সবাইকে মেরে ফেলা হয়। আমরা খুব কষ্টের মধ্যে শুটিং করছি। চারদিকে মাইন পোঁতা আছে। বিভিন্ন মরদেহ, কঙ্কাল অহরহ। দেখলাম, এক জায়গায় একটি মেয়ের হাতের লেখা—‘একটু পরে আমাকে নিয়ে ফুর্তি করা হবে।’ ওই সব দেখে আমিও জানি কেমন হয়ে গেছি। আমার মনে হচ্ছে, আমি যেন সেখানকারই মেয়ে।
এ ছবি প্রসঙ্গে একটা শুটিংয়ের দৃশ্যের কথা বলি। ছবিতে দেখানো হবে, আমার সামনে পরিবারের সবাইকে মেরে ফেলা হচ্ছে, আর আমাকে তুলে নিয়ে ফুর্তি করা হচ্ছে। আমার মনে হচ্ছিল, আমি যেন সত্যিই এমন অবস্থায় পড়েছি। ক্যামেরা চালু হওয়ামাত্র আমি এমনভাবে কাঁদতে থাকি, ক্যামেরা বন্ধ হওয়ার পরও কেঁদেই যাচ্ছিলাম। শুটিং শেষ হওয়ার পর সুভাষদা আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘ববিতা, তোমার অভিনয় চমৎকার হয়েছে।’ আমি তখনো কাঁদছি। সে কী কান্না আর কান্না! আমি কেঁদেই চলেছি। দাদা বললেন, ‘তুমি আর কেঁদো না।’
অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষীর শুটিং করতে গিয়ে আমার আরেকটি ঘটনার কথা এ মুহূর্তে মনে পড়ছে।
সে সময় বেশ গরম ছিল। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের পাশেই একটি পাহাড়। সেই পাহাড়ের পাশ থেকে আমাকে দৌড়ে আসতে হবে। আহমেদ শরিফ ছিলেন আমার সঙ্গে এ দৃশ্যে। তো, দত্তদা বললেন, ‘তুমি সংলাপ বলতে বলতে অজ্ঞান হয়ে যাবে।’ বেবী জামান ভাই ক্যামেরা চালু করতেই আমি চিৎকার করে বললাম, ‘এই জীবন আমি আর রাখব না’ বলে দৌড়ে এসে মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম। দত্তদা তো চিৎকার করে ‘অসাধারণ, অসাধারণ’ বলতে লাগলেন! কিন্তু আমি যে সত্যি সত্যি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি, এটা আর কেউই বুঝতে পারছিলেন না। যখন দেখলেন ববিতা তো উঠছে না, তখন সবাই নাকি আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। কেউ মাথায় পানি ঢেলেছেন, কেউ চিকিৎসকের খোঁজে ছুটেছেন। কিছুক্ষণ পর যখন জ্ঞান ফিরে এল তখন দেখি, সবাই আমাকে ঘিরে বসে আছেন। আসলে ছবির গল্পের ও চরিত্রের সঙ্গে আমি এতটাই মিশে গিয়েছিলাম যে আমি নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারিনি। সে সঙ্গে আবহাওয়া এত গরম ছিল যে মাথা ঘুরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আর অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী ছবিতে কাজ করেই কিন্তু জীবনের প্রথম পুরস্কার পেলাম। সে সঙ্গে এ ছবিই আমাকে এনে দিল অন্য রকম এক পরিচিতি। সত্যিই, দত্তদার কাছে আমি ভীষণ কৃতজ্ঞ। অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলোতে কাজ করার অফার আসতে লাগল।
খান আতার আবার তোরা মানুষ হ ছবিতে কাজ করলাম। দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু আমরা কী করছি, আমাদের তরুণ প্রজন্ম কী করছে—এ নিয়ে আতা ভাই ছবিটি তৈরি করলেন। এ ছবির কাজ করার সময় ওই সময়ের সুপারহিট পরিচালক নারায়ণ ঘোষ মিতা আলোর মিছিল ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু চলচ্চিত্রের কিছু মানুষ আমাকে পরামর্শ দিলেন, এ ছবিতে যেন আমি অভিনয় না করি। আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন? এত সুন্দর একটি গল্প এবং ছবির পরিচালকও অনেক সম্মানিত ব্যক্তি, তার পরও আমি না করে দেব! তাঁরা আমাকে বোঝালেন, দেখুন, আলোর মিছিল ছবিতে রাজ্জাক ভাই ও সুজাতা আপা হলেন আসল নায়ক-নায়িকা। আপনি তাঁদের ভাগনির চরিত্রে অভিনয় করবেন। শেষের দিকে আবার মারাও যাবেন। এ ছবিতে এই চরিত্রে যদি কাজ করেন, তাহলে আপনার ইমেজ ক্ষুণ্ন হতে পারে। তখন আমি দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম। নারায়ণদা এসে আমাকে বললেন, ‘দেখো, এই ছবিতে তোমার যে চরিত্র, সেটার গ্রহণযোগ্যতা অন্য রকম। মানুষ তোমারই প্রশংসা করবে। আর তুমি যদি এখন করতে না চাও, তাহলে আমি কাকে নেব?’ দাদার কথা শুনে সুচন্দা আপা বললেন, ‘পপি, ছবিটিতে তুমি কাজ করো। দাদা যখন নিজে বলছেন, তাতে করে মনে হয় যে এ কাজটা করলে তোমার ইমেজ ক্ষুণ্ন হবে না।’ এর মধ্যে আবার রাজ্জাক ভাইও ছবিটিতে কাজ করার কথা বললেন। আমি কাজ শুরু করলাম। এ ছবিতে কাজ করতে যেটা হলো, চোখে কোনো গ্লিসারিন ব্যবহার করতে দিলেন না নারায়ণদা। দাদার একটাই কথা, সময় লাগে লাগুক, কিন্তু তোমাকে সত্যি সত্যি কাঁদতে হবে। এবং একবার-দুবার চেষ্টা করে সত্যি সত্যি দেখা গেল, পুরো ছবিতে কোথাও গ্লিসারিন ব্যবহার না করেই আমি শুটিং করলাম। ছবিটি মুক্তির পরে সবাই প্রশংসা করলেন। ছবিটি পুরস্কৃত হলো।

No comments

Powered by Blogger.