মৃদুল চক্রবর্তীর মৃত্যু ও তারপর by বদিউর রহমান

চিরবিদায় নিলেন অধ্যাপক মৃদুল কান্তি চক্রবর্তী। সঙ্গীতের তত্ত্বগত বা একাডেমিক, গায়ন বা সুর-ছন্দ-তাল-লয় কিংবা গায়কী বা পরিবশনা_ সবদিকে একজন চৌকস ব্যক্তিত্ব ছিলেন মৃদুল কান্তি চক্রবর্তী। সামগ্রিক অর্থে ছিলেন যথার্থ সঙ্গীত গবেষক। লোকসঙ্গীত, বাউলসঙ্গীত, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি,

গণসঙ্গীত ইত্যাদি কোনো ধারাই বাদ যায়নি মৃদুলের চর্চা থেকে। অনুসন্ধান ও গবেষণা করেছেন রাধারমণ দত্ত, শাহ বারিদ, গগন হরকরা, হাছন রাজা, লালন শাহ, আমিরউদ্দিন, শাহ আবদুল করিম, মুকুন্দ দাস প্রমুখের গান নিয়ে। সবার ওপরে অন্তরে ধারণ করেছেন রবীন্দ্রসঙ্গীত আর ধ্রুপদী সঙ্গীত। কেবল গান নয়, মৃদুল কান্তির গবেষণা বাদ্যযন্ত্র নিয়েও, আবিষ্কার করেছেন নতুন বাদ্যযন্ত্র। মৃদুল কান্তি মারা গেলেন ১৫ আগস্ট দেশের অন্যতম বৃহৎ চিকিৎসা সেবাকেন্দ্র ল্যাবএইড হাসপাতালে। তিনি হাসপাতালে ঢুকেছিলেন হেঁটে। খুব বেশি সময় লাগেনি, মাত্র ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই দেশের এই বড়মাপের হাসপাতাল চিকিৎসাকর্ম সাঙ্গ করে চিরবিদায় দিল এই গুণী মানুষটিকে।
অভিযোগ উঠেছে চিকিৎসায় বিলম্ব, অবহেলা এবং ভুল চিকিৎসার। সকাল সাড়ে ৯টা-পৌনে ১০টার দিকে ড. মৃদুল কান্তি চক্রবর্তী ল্যাবএইড হাসপাতালে যান; মূল উদ্দেশ্য কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো। সঙ্গে ছিল দশ হাজার টাকা।
ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষ সঙ্গে থাকা দশ হাজার টাকায় ভর্তি করে চিকিৎসা দিতে পারল না ড. চক্রবর্তীকে; কারণ তাদের চাহিদা এগারো হাজার টাকা। ড. চক্রবর্তীর কী অসুখ, কী পরীক্ষা করাতে হবে, কী চিকিৎসা দিতে হবে, ক'দিন থাকতে হবে হাসপাতালে_ কিছু না দেখে, না বুঝেই তার ভর্তি ফি ধার্য করা হলো এগারো হাজার টাকা। ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষের কাছে হয়তো এগারো হাজার টাকা কিছু নয় বা ল্যাবএইডের মতো স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের সুরম্য দরজায় প্রবেশ ফি মাত্র এই এগারো হাজার টাকা!
ড. মৃদুল কান্তি চক্রবর্তীর এ ঘটনা নানা প্রশ্নের জন্ম দিতে পারে। একটি নামিদামি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের কাছে একজন রোগীর, তিনি যতই সাধারণ মানুষ হোন, তার কি কোনোই মূল্য নেই? কেন তিনি এমন কোনো স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের দরজায় গিয়ে টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় মারা যাবেন? ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষ পঞ্চাশ লাখ টাকা দিয়েছে ড. মৃদুল কান্তি চক্রবর্তীর পরিবারকে। দিয়েছে ড. মৃদুল চক্রবর্তীর পরিবারকে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে ল্যাবএইডের সিএসআর (করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা) তহবিল থেকে। যে তহবিল থেকে সাধারণত দান-খয়রাত দেওয়া হয়। যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ভিক্ষা চেয়েছিলেন ল্যাবএইডের মহাজনদের কাছে। 'ক্ষতিপূরণ' কথাটি বলতে তারা নারাজ। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অন্যান্য দাবির ব্যাপারে ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষ এখনও আগের অবস্থানেই। যারা টাকার মানদণ্ডে সবকিছু মেপে অভ্যস্ত, তাদের কাছ থেকে আর কী-ইবা আশা করা যায়? ড. মৃদুল চক্রবর্তীর মৃত্যুর বিষয়টি ইতিমধ্যে দেশের উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। রুল আদেশে আগামী ২৩ আগস্ট ল্যবএইড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে আদালতে উপস্থিত হয়ে ড. মৃদুল কান্তি চক্রবর্তীর চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে দুই সপ্তাহের মধ্যে দশ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করতে; যে কমিটি দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে দ্রুত এবং সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে একটি নির্দেশনা বা 'গাইডলাইন' তৈরি করবে। আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় বিশেষ করে বেসরকারি খাতে কোনো নীতিমালা বা নির্দেশনা না থাকাই এর মূল কারণ। ডাক্তারের ফি, কোনো পরীক্ষার ফি, ক্যাবিন ভাড়া কোনো কিছুরই ঠিকঠিকানা নেই এ দেশে। যারা সব পরীক্ষায় ২৫% ছাড় বলে লাখ লাখ টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন দেয় প্রতিনিয়ত, তাদের কি কোনো নির্ধারিত হার বা রেট আছে? থাকলে তা কে নির্ধারণ করেছে? নেই 'চিকিৎসাসেবা' কথাটির নূ্যনতম ব্যবহার; তা নেই কোনো প্রতিষ্ঠানেই। এসব নির্ধারণ হওয়া জরুরি। ড. মদুল কান্তি চক্রবর্তীর ঘটনার সূত্র ধরে স্বাধীন বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ তাদের অন্যতম মৌলিক অধিকার স্বাস্থ্যসেবার নূ্যনতম দিকনির্দেশনা পেলে হয়তো তার আত্মা কিছুটা শান্তি পাবে। সে জন্য আমরা চেয়ে থাকব দেশের সরকার আর মহামান্য আদালতের দিকে। ড. মদুল কান্তির জন্য আমাদের বিনীত শ্রদ্ধা।

বদিউর রহমান : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক ও লেখক
 

No comments

Powered by Blogger.