মৈত্রী ও মানবিকতার প্রাণপুরুষকে অভিবাদন-সার্ধশততম রবীন্দ্রজয়ন্তী

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মের দেড় শ বছর অতিক্রম হওয়া নিঃসন্দেহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্টিকর্মের জন্য তো বটেই, বাংলাভাষীদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। বাঙালির মানসলোক নির্মাণে রবীন্দ্রনাথের অবদানের কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। তেমনি অস্বীকার করার উপায় নেই যে রবীন্দ্রনাথ বাঙালি কবি হিসেবে সব বাঙালির ভাবের আত্মীয়,

তেমনি উপমহাদেশীয় কবি হিসেবে তিনি উপমহাদেশীয় মৈত্রীরও সেতু। সার্ধশততম রবীন্দ্রজয়ন্তী এবার তাই দুই বাংলার বাঙালিদের মধ্যে যেমন, তেমনি ভারত-বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মৈত্রীরও প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এ উপলক্ষে বাংলাদেশ ও ভারত এবারই প্রথম যৌথভাবে তিন দিনব্যাপী রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করছে।
গত শুক্রবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনকেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সার্ধশততম রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠানের শুভ উদ্বোধন করেন। এ উপলক্ষে ভারতের উপরাষ্ট্রপতিসহ সে দেশের গুণীজনদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়। একইভাবে বাংলাদেশের পরিকল্পনামন্ত্রীর নেতৃত্বে সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদল ভারতে সংবর্ধিত হচ্ছে। আসলে এর মাধ্যমে উভয় দেশের সংস্কৃতির এক মহান পুরুষের অবদানের প্রতি যেমন সম্মান জানানো হচ্ছে, তেমনি সম্মানিত হচ্ছে দুই প্রতিবেশী। এটা মোটেই আশ্চর্যের বিষয় নয়, বাংলাদেশ ও ভারতের জাতীয় সংগীত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা। একইভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা-কলকাতায় চলাচলকারী ট্রেনের নাম রবীন্দ্রনাথের কবিতার নামে ‘সোনার তরী’ রেখে রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকারকে আন্তরাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আরও অর্থবহ করে তোলেন।
কেবল জাতীয় পর্যায়েই নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সার্ধশততম রবীন্দ্রজয়ন্তী বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হচ্ছে। পাশাপাশি উচ্চারিত হচ্ছে বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশেরও নাম। কেননা, যে বাংলা বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা, রবীন্দ্রনাথ সেই ভাষারই শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক। অন্যদিকে, রবীন্দ্রনাথের জীবনে বাংলাদেশের প্রভাবও আলাদাভাবে লক্ষণীয়। সেই গুরুত্ব বিবেচনায় জাতীয় গণমাধ্যমে এবং রাজধানী ও এর বাইরেও দিবসটি উদ্যাপন শুরু হয়েছে। এসব থেকে জন্মের দেড় শ বছর পরও রবীন্দ্রনাথের ক্রমবর্ধমান প্রাসঙ্গিকতারই প্রমাণ পাওয়া যায়।
বাংলাদেশের মানুষের কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইতিহাসে তাদের আত্মপ্রকাশের সহযাত্রী। রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতা ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের স্বাধীনতাসংগ্রাম পর্যন্ত বিরাট প্রেরণার উৎস হয়ে ছিল। বিশ্বে খুব কম কবিই এ রকমভাবে কোনো দেশের জাতীয় স্বাধীনতাসংগ্রামকে প্রভাবিত করতে পেরেছেন। রবীন্দ্রনাথ তাই কেবল ব্যক্তিগত নন, নন কেবল সাংস্কৃতিক; বাংলাদেশের রবীন্দ্রনাথ রাজনৈতিকও বটে। যখনই অন্যায়-অবিচার ঘনিয়ে আসে, যখনই সাংস্কৃতিক উজ্জীবনের প্রয়োজন হয়ে পড়ে, তখনই রবীন্দ্রনাথ তাঁর সব সৃষ্টিকর্ম নিয়ে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ান।
মানবিকতার প্রয়োজনে, মানুষ ও প্রকৃতির মঙ্গলের ইচ্ছায়, জাতিতে জাতিতে মৈত্রীর প্রেরণায় তাঁর গান-কবিতা-নাটক ও চিন্তা পাথেয় হয়ে বিরাজ করেছে এবং করবে। কেবল ভক্তির আতিশয্য নয়, ভালোবাসা ও নতুন নতুন উপলব্ধি জাগিয়ে রবীন্দ্রনাথ আরও অনেক দিন আমাদের আত্মার বান্ধব হয়ে থাকবেন, তেমনি থাকবেন মৈত্রীর প্রতীক হয়েও।

No comments

Powered by Blogger.