থাইল্যান্ড-লাল শার্টের বিদ্রোহীরা by হান্না বিখ

ব্যাংককের এক প্রমোদকেন্দ্রে এক বিদেশি জানতে চান, ‘লাল শার্টদের সমর্থক কারা?’ দামি বোরদৌ মদের ছিপি খুলতে খুলতে এক থাই উত্তর দেন, ‘কেউ না’। তারপর বিড়বিড় করে বলেন, ‘তবে গরিবেরা ছাড়া’।গত মার্চের মাঝামাঝি বিরোধী ‘লাল শার্টরা’ ব্যাংককে বিরাট বিক্ষোভের ডাক দিলে নগরের মেয়র অধিবাসীদের ‘ঘরে থাকার’ অনুরোধ করেন।


বাসে, ট্রাকে, নৌকায়, পিকআপে করে হাজার হাজার মানুষ গ্রামাঞ্চল থেকে ব্যাংকক অভিমুখে রওনা হলে ব্যাংককের মিডিয়া বিপর্যয়ের হুঁশিয়ারি জানায়। কিন্তু পরিস্থিতি বদলে গেল অপ্রত্যাশিতভাবে। মাইলের পর মাইল দীর্ঘ লাল শার্টের গাড়িবহর ব্যাংককে ঢুকছে আর ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে শহরের গরিব ও মধ্যবিত্তরা। বাবুর্চিরা তাদের খুন্তি নাড়াচ্ছে, বিউটি পার্লারের মেয়েরা নাড়ছে রুমাল, স্টারবাক বারিস্তার পরিচারকেরা তালে তালে দিচ্ছে হাততালি। ব্যাংককের এয়ারকন্ডিশন-শোভিত অভিজাত এলাকা থেকে দূরে, ৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার ঘামে ঝরতে ঝরতে নগরের নিম্নবিত্তরা বলছে সেই কঠিন কথাটি, ‘আমরা লালদের ভয় পাই না, কারণ আমরাও লাল।’ লাল শার্ট পরা আন্দোলনকারীরা একে বলছে ‘শ্রেণীসংগ্রাম’। এই অভিধা কেবল নামেই নয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় থাইল্যান্ড ছিল মার্কিন সেনাদের লীলাভূমি। সেখান থেকে দেশটি পরিণত হয়েছিল দক্ষিণ এশিয়ার পণ্য প্রস্তুতকারী, পৃথিবীর বৃহত্তম ধান রপ্তানিকারক এবং গোটা দুনিয়ার প্রমোদকেন্দ্রে। এর পরও অনেক থাইকে ধানখেতে কিংবা মাছের খামারে দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ে থাকতে হয়। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি যা হয়েছে তার দেখা তারা পায়নি, সুফল নিয়ে নিয়েছে বড়লোকেরা। এ অঞ্চলে এখন থাইল্যান্ডের আয়বৈষম্য সবচেয়ে মারাত্মক। রাজধানী ব্যাংকক কাঁপানো লাগাতার বিক্ষোভে যে লাখো লাল শার্ট পরা মানুষ জড়ো হয়েছে, তারা থাইল্যান্ডের জনগণের এই ক্ষোভেরই প্রতিনিধি। বছরের পর বছর ধরে বঞ্চনার বিরুদ্ধে দানা বাঁধা ক্ষোভই এখন বিস্ফোরিত হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী অভিজিত্ ভেজ্জাজিভার সরকারের বিরুদ্ধে।
রাজপথের এই বিক্ষোভ কেবল অক্সফোর্ড পাস অর্থনীতিবিদ বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধেই নয়; জনগণের অনেকের চোখেই সমগ্র রাজনৈতিক গোষ্ঠী ও সামরিক মহল গরিববিরোধী। যদিও অভিজিত্ ক্ষমতায় এসে কিছু কিছু গরিবমুখী কর্মসূচি নিয়েছিলেন, তার পরও মানুষ এর স্থায়ী প্রতিকার চায়।
২০০৬ সালে জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী থাকসিন এক সেনা অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারান। ওই বছরই অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সর্বোচ্চ ভোট পায় থাকসিন-সমর্থক দল। নতুন সরকার থাকসিনকে ফিরিয়ে আনবে এই ভয়ে অভিজাত ও ধনীদের সমর্থক হলুদ শার্টরা সেনাবাহিনীর মদদে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও বিমানবন্দর দখল করে নেয়। ওদিকে উচ্চ আদালত কারচুপির কথা বলে বিজয়ী দলকে বঞ্চিত করেন। পর্দার আড়ালের দেনদরবারের মাধ্যমে অভজিতের নেতৃত্বাধীন জোটই সুযোগ পায় সরকার গঠনের। লাল শার্টদের এক শীর্ষস্থানীয় নেতার অভিযোগ, ‘এটা জনগণের নির্বাচিত সরকার নয়। অভিজিত্ বিদায় হও এবং জনগণের কাছে ক্ষমতা ফিরিয়ে দাও।’
লাল শার্ট নেতারা জানেন, তাঁদের জনপ্রিয়তার ভিত্তি হলো বড়লোকদের বিরুদ্ধে গরিবদের বিদ্বেষ। তাঁদের চোখে এটি অভিজাতদের বিরুদ্ধে ভূমিদাসদের লড়াই। যদিও তাঁদের কোনো কোনো নেতা ধনিক শ্রেণীর লোক এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন নিজেও ছিলেন দেশের শীর্ষ ধনীদের একজন, তথাপিও তিনি তাঁর ক্ষমতা ব্যবহার করে গরিবদের অর্থনৈতিক সুবিধার ব্যবস্থা করে ভোটারদেন মন জয় করে ফেলেন। প্রধানমন্ত্রী অভিজিত্ টেলিভিশনে বলেন, ‘থাইল্যান্ডে আর শ্রেণী নেই, সব মানুষ সমান, তবে সবার সুযোগ সমান নয়।’ কিন্তু চুয়ালংকর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের কথা হলো, ‘গরিবেরা খাটে বেশি, দেয়ও বেশি। তার পরও তারা ভিড়ের মধ্যে লক্কড়ঝক্কড় বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে, আর বড়লোকেরা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত লিমুজিনে করে ঘোরে।’
থাকসিন ধনকুবের হয়েও গ্রামীণ গরিবদের ক্ষমতা ও সচ্ছলতার স্বাদ দিয়েছিলেন। তাঁর ব্যাপক ভর্তুকির স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি, বিনা সুদে ক্ষুদ্রঋণের মতো জনমুখী কর্মসূচি তাঁকে জনপ্রিয় করে তোলে। এসব কারণেই তিনি থাই ইতিহাসের সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে যান। কিন্তু ২০০৬ সালে জনপ্রিয় এই নেতা সেনা অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারান।
বর্তমানে ধনী ২০ শতাংশ মানুষ থাইল্যান্ডের তিন ভাগের দুই ভাগ সম্পদের মালিক। অভিজিতের মুখপাত্র পানিতান বলছেন, ‘ব্যাংককের অনেক এলাকাতেই ধনী আর গরিবেরা পাশাপাশি বাস করছে। আয়বৈষম্য সেখানে এত প্রকট; হয়তো এখনই ল্যাটিন আমেরিকার মতো সংঘর্ষ লেগে যাচ্ছে না, কিন্তু অচিরেই গণবিক্ষোভ স্থায়ী ব্যাপারে পরিণত হবে।’
বিক্ষোভকারীরা এখনই নির্বাচন চায়। অভিজিত্ সেটা মানছেন না। (গত শুক্রবার ব্যাংককে সেনা-জনতা সংঘর্ষে নয়জনের প্রাণহানি ঘটেছে) কেননা, এই মুহূর্তে নির্বাচন হলে থাকসিন-সমর্থকেরাই বিজয়ী হবে। এর মুখে গত মার্চে লাল শার্টরা অভিজিতের বাড়ি ও দপ্তরের সামনে নিজেদের শরীরের রক্ত ঢেলে চূড়ান্ত হুঁশিয়ারি জানিয়ে দেয়। সরকার ও ধনীদের বিরুদ্ধে তাদের স্লোগান হলো, ‘দেশ জ্বলছে’।
তবু লালদের এত বিপুল বিক্ষোভের পরও বোঝা যাচ্ছে না, কীভাবে থাইল্যান্ড সামনের দিকে এগোবে। দুদিকেই অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। অভিজিত্ সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন, কিন্তু গত চার বছরে এ ধরনের সংলাপে কোনো সমাধান আসেনি। ওদিকে থাইল্যান্ডের রাজনীতির শেষ ভরসা রাজা ভূমিবল গত সেপ্টেম্বর থেকে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। এ পর্যন্ত তাঁর মুখে কোনো বাণী ফোটেনি।
কিন্তু পরিস্থিতি বলছে, থাইল্যান্ডের বর্তমান সেনা-সমর্থিত সরকারের জায়গায় গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা এবং অভিজাত শ্রেণীর বিপরীতে গরিব ও মধ্যবিত্তদের দাবি দিনকে দিন জোরালোই হয়ে উঠবে।
টাইম ম্যাগাজিন থেকে নেওয়া, সংক্ষেপিত ভাষান্তর ফারুক ওয়াসিফ
হান্না বিখ: টাইম এর প্রতিবেদক।

No comments

Powered by Blogger.