নৃত্যকলা-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে স্বতন্ত্র বিভাগ প্রয়োজন by শেখ মেহেদী হাসান

আমাদের দেশে শিক্ষা কাঠামোয় বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের জন্য শিল্পশিক্ষার তেমন সুযোগ নেই। ছকবাঁধা নিয়ম আর একঘেয়েমি পাঠক্রম অনুসরণ করে তারা হাঁপিয়ে ওঠে। তারা আনন্দ নিয়ে পড়তে পারে না। ফলে শিশু-কিশোরদের মূল্যবোধের বিকাশ থেমে যায়। নৃত্যকলা শিল্পশিক্ষা হিসেবে আনন্দদায়ক এবং সুশৃঙ্খল নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ তৈরি করতে পারে।


দেশের প্রাথমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাঠ্যক্রমে নৃত্য অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃত্যকলা বিষয়ে স্বতন্ত্র বিভাগ। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নৃত্যকলা, সংগীত, নাটক ও তালযন্ত্র বিভাগ নিয়ে পৃথক একটি পারফরমিং আর্টস অনুষদ প্রতিষ্ঠা হতে পারে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২৬ সালে শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃত্যকলা বিভাগ চালু করেছিলেন। কেননা নৃত্য মানুষের সুকুমার শিল্পের বিকাশ ঘটায়। যদিও নৃত্য শিখতে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। কিন্তু নৃত্য পরিবেশনা সহজে মানুষকে আকর্ষণ করে। এশিয়ার দেশ চীন, জাপান, ভারত, কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালেশিয়াসহ পৃথিবীর নানা দেশে বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নাটক ও নৃত্যকলা বিভাগ রয়েছে। অথচ বাংলাদেশে এ বিষয়ে একাডেমিক পর্যায়ে পঠন-পাঠনের সুযোগ না থাকায় অন্যান্য দেশ থেকে আমরা পিছিয়ে পড়ছি।
১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ঢাকার র্যাংকিন স্ট্রিটে গওহর জামিল তাঁর বন্ধু রবিশঙ্কর চ্যাটার্জিকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘শিল্পকলা ভবন’। এটিই পূর্ববঙ্গের প্রথম নাচের স্কুল। তারপর ব্যক্তিগত উদ্যোগে সুরবিতান, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি, জাগো আর্ট সেন্টার, ছায়ানট, নিক্কন ললিতকলা কেন্দ্র, বেণুকা ললিতকলা কেন্দ্রসহ নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সারা দেশে প্রায় ২২৫টি সংগীত স্কুলে গড়ে ১৭ হাজার শিক্ষার্থী নিয়মিত নৃত্য প্রশিক্ষণের সুযোগ পাচ্ছে। তার প্রধান কারণ অভিভাবকদের উৎসাহ এবং সমাজে নৃত্যকলার মতো সৃজনশীল শিল্পকলার গ্রহণযোগ্যতা। সবচেয়ে বড় কথা তরুণেরা পড়াশোনার পাশাপাশি শিল্পচর্চার সঙ্গে যুক্ত থাকলে অপরাধ প্রবনতা বা মাদকাসক্তির মত অবক্ষয় থেকে দুরে থাকতে পারে।
বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বিনিময় চুক্তি রয়েছে। সরকার নানা দেশে সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দল পাঠায়। সেখানে দেশীয় নৃত্য পরিবেশনা অনিবার্য থাকে। সব মিলিয়ে নৃত্যচর্চা আমাদের দেশে পেশাদার মর্যাদা পেয়েছে। ভারত, চীন ও জার্মানি থেকে প্রায় অর্ধশত এবং দেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বহু শিল্পী নৃত্যচর্চাকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। বুলবুল চৌধুরী পাকিস্তানের জাতীয় নৃত্যশিল্পী ছিলেন। নৃত্যকলায় অবদানের জন্য সরকার এ পর্যন্ত আটজন নৃত্যশিল্পীকে রাষ্র্বীয় একুশে পদক দিয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা, নাটক ও সংগীত এবং জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত বিভাগ রয়েছে। সরকারি সংগীত মহাবিদ্যালয়ে বহু শিক্ষার্থী গান শেখার সুযোগ পাচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার জন্যই আমাদের নাটক ও চারুকলা আজ বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেয়েছে। এশীয় চারুকলা প্রদর্শনী ও ছবি মেলার মতো পৃথিবীর সেরা চারুকলা ও আলোকচিত্র প্রদর্শনী বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়।
দেশের মোট ২৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে (যার মধ্যে আছে সাধারণ, প্রকৌশী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো) স্নাতক প্রথমবর্ষে ভর্তির জন্য আসন নির্ধারিত রয়েছে প্রায় দুই লাখ। ১৪টি সরকারি মেডিকেল কলেজে আসন আছে দুই হাজার ২৬০; লেদার, টেক্সটাইল, কারিগরি ও বেসরকারি মেডিকেল মিলিয়ে আরও আছে চার হাজার আসন (ভোরের কাগজ, ২৭ জুলাই, ২০০৯)। এর বাইরে ৫১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৬০ হাজার আসন আছে। সারা দেশে সরকারি অনার্স কলেজ আছে ৪১টি, বেসরকারি অনার্স কলেজ আছে ২০টি, সরকারি মাস্টার্স কলেজ ২৮টি, সরকারি ডিগ্রি কলেজ ১৩৯টি এবং বেসরকারি ডিগ্রি কলেজ এক হাজার ৪৮টি (যুগান্তর, ৮ আগস্ট, ২০০৯)। এসব প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পাঠ দেওয়া হয়। অথচ নৃত্যকলা ও চলচ্চিত্র সারা পৃথিবীতে দেশকে উপস্থাপন করলেও এসব বিষয়ে কোথাও পড়ার সুযোগ নেই। দেশের সর্ববৃহত্ বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নৃত্যকলা, চলচ্চিত্র, নন্দনতত্ত্ব, লোকসংস্কৃতি ও জাদুঘরবিদ্যা বিভাগ চালু হলে শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত পরিবর্তন সূচিত হবে। নৃত্যশিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ভেতরে এই বিশ্বাস জন্মাবে যে, নৃত্যই পারে একটি সুস্থ জীবনধারা গড়ে তুলতে। একই সঙ্গে তারা স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তার বিকাশ ও সামাজিক দায়বদ্ধতা সম্পর্কেও সচেতন হয়ে উঠবে।
আমাদের দেশে অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানদের চিকিৎসা, প্রকৌশল, অর্থনীতি ও আইন পড়াতে চান। অথচ প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কর্মসংস্থানের সুযোগও তেমন নেই। অনেকে চিকিৎসাশাস্ত্র পড়ে প্রশাসনে চাকরি করছেন। নৃত্যকলার পাঠক্রমে বাংলাদেশ স্টাডিস, সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান, কমিউনিকেশন, শিল্পকলার ইতিহাস, নাট্যসাহিত্যের ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, গবেষণা পদ্ধতি, পারফরমেন্স স্টাডিস প্রভৃতি বিষয় সংযুক্ত হলে পেশাদার শিল্পী ও দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য দক্ষ কর্মীও তৈরি হতে পারে। সর্বোপরি সৃজনশীল ও সমৃদ্ধ মানুষ তৈরির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্যান্য শিল্পকলার পাশাপাশি স্বতন্ত্র নৃত্যকলা বিভাগ প্রতিষ্ঠা হওয়া জরুরি।
শেখ মেহেদী হাসান: গবেষক, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
cdr.dance@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.