প্রতিক্রিয়া-সহিংসতার ভয়টি ‘তরল’ নয়, জমাট by ফারুক ওয়াসিফ

২০০ বছর আগের কথা। পিয়েরে রিভিয়েরে নামের এক ফরাসি তরুণ তার মা, ভাই ও বোনকে খুন করে। ঘটনাটা এত দূর আলোড়ন তোলে যে খুনির মন বুঝতে তার মানসিক অবস্থা সম্পর্কে প্রতিবেদন তৈরি করতে বলা হয়। সে সময়ের প্যারিসের বাঘা বাঘা মনোরোগ বিশেষজ্ঞও ঘটনাটিকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করতে থাকেন। অপরাধের পেছনে তাঁরা সমাজ ও সংস্কৃতির সম্পর্কটা খুঁজতে নামেন।


খুন-খারাবি তো দুনিয়ায় নতুন নয়। কিন্তু পিয়েরে রিভিয়েরের বেলায় নতুন হলো এ নিয়ে গবেষণা। কেবল তাকে শাস্তি দেওয়ার মামলা হলে সেটা পুলিশের জিম্মায় অনায়াসেই সারা যেত। কিন্তু ফরাসি কর্তৃপক্ষ বুঝতে চেয়েছিল, কোন অবস্থায় দেশে অপরাধ ও নৈরাজ্য বেড়ে যায়? তারা জানত কেবল শাস্তিতে সব অপরাধের প্রতিকার হয় না। হাতটা দিতে হয় গোড়ায়। সেটা পুলিশের কাজ নয়, সাংবাদিকেরও নয়। কাজটা গবেষকের, রাজনীতিবিদের, সমাজের বিবেকের; সবার। কিন্তু বাংলাদেশে সংবাদপত্রে প্রকাশিত অপরাধের রোজনামচা আর পুলিশের চার্জশিটের মাধ্যমেই প্রতিকারের দায় সারা হয়ে যায়। আমরা যে তিমিরে ছিলাম, সেই তিমিরেই থাকি।
বহুদিন থেকে বাংলাদেশে নিম্নমাত্রার, কিন্তু মোটামুটি স্থায়ী এক নৈরাজ্য চলছে। কোনো কিছুই ঠিকমতো চলছে না, অথচ পড়পড় করেও ভেঙে পড়ছে না ঠিক। কিছুটা নিয়ন্ত্রণ, কিছুটা আইন, কিছুটা সামাজিকতা আছে। নইলে শাসন ও জীবন কিছুই তো চলবে না। এর মধ্যেই সমগ্র সামাজিক-রাজনৈতিক বয়নটিই উত্তেজনা ও অসহিষ্ণুতায় কাঁপছে। তুচ্ছ ঘটনা জন্ম দিচ্ছে অতিকায় হিংসার, একই সঙ্গে ঝরছে রক্ত ও অশ্রু। একদিকে কিছু মানুষের খোলস খসে গিয়ে, বদলে গিয়ে নির্যাতক হয়ে উঠছে, অন্যদিকে অনেকের জীবন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। একেকটি ঘটনার পর আমরা পাচ্ছি এক নতুন খুনি-ধর্ষক-নির্যাতক, অন্যদিকে পড়ে থাকে মানবতার নির্যাতিত ও নিহত দেহটি। মনে রাখতে হবে, দুজনই কিন্তু সমাজেরই সদস্য।
এই সহিংসতা ও অসন্তোষ বিদ্যমান ব্যবস্থারও খেসারত। রাজনীতি ও অর্থনীতির জগতে তৈরি হওয়া ঘূর্ণিঝড় ব্যক্তির মনকেও উত্তপ্ত ও সহিংস করে তুলতে পারে। প্রবৃদ্ধির অর্থনীতি কিংবা ভোটাভুটির গণতন্ত্র যতই জমে উঠুক; মানুষ ও প্রকৃতি দিন দিন আরও বিপর্যস্ত ও অসহায় হচ্ছে। পানি দূষিত হলে যেমন সবকিছুর মধ্যে সমস্যা দেখা দেয়, তেমনি সামাজিক পরিমণ্ডলের দূষণও বিষিয়ে তোলে আমাদের জীবনকে। সম্প্রতি দুই পেঙ্গুইন থেকে প্রকাশিত দ্য স্পিরিট লেভেল গ্রন্থে দুই গবেষক রিচার্ড উইলকিংসন ও কেট পিকেট দেখিয়েছেন, কম বৈষম্যের সমাজে জীবন সর্বদাই শান্তিময়হয়।
জীবনের নৈরাজ্য মনকেও অস্থির করে, স্নায়ুতে চাপ বাড়ায়। মানুষ এর মধ্যে একা হয়ে যায়। কঠিন বাস্তবতায় কঠিন হয়ে যায় সেই একা মানুষদের মন। সম্পর্ক ক্ষয়ে যায়, পরস্পরের প্রতি দায় ও চক্ষুলজ্জাও ততই কমে।
গ্রাম কি শহর—সবখানেই আগেকার সমাজ আর নেই। বস্তির অমানবিক পরিবেশ কিংবা অভিজাত এলাকার দ্বীপের মতো বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন কিংবা মধ্যবিত্তদের ঘিঞ্জি বসতিতে সমাজ টেকে না; থাকে না সামাজিকতা। অথচ প্রতিবেশীদের মুখ না দেখলেও বাজারের দোকানির সঙ্গে কিংবা কর্মস্থলের প্রতিযোগীদের সঙ্গে নিত্য দেখা হয়। বাজার যতই জাগ্রত হয় সমাজ হয় ততই নিস্তেজ। এই নিস্তেজ সমাজের নিস্তেজ মানুষকে তখন সহজেই উত্তেজিত করে তেলে মোহ ও মোহভঙ্গের ঘটনা। পুরোনো নৈতিকতার অনুশাসন আলগা হতে থাকে। পারস্পরিক অসম্মান আর অসহিষ্ণুতার বিস্তারও বাড়ে। চলতে থাকে দুর্বলের ওপর সবলের ইচ্ছা ও বাসনার বিজয়। সবাই এর শিকার হলেও বিশেষত নারী তথা অপ্রাপ্তবয়স্ক নারীর বিপন্নতা বাড়ে। সব কটি নারী নির্যাতন ও খুনের ঘটনায় সেই চিহ্নই ভাসে।
আইনকানুন, নিয়মনীতি যারা মানে না, তাদের কাছে বলপ্রয়োগই হলো প্রেম ও প্রতিপত্তি অর্জনের উপায়। বাংলাদেশে এখন আইন আর ক্ষমতার একমাত্র প্রতিনিধি নয়; আরও অনেক ক্ষমতা আছে। আইনি ক্ষমতা সীমিত হলেও বেআইনি ক্ষমতা হয় সীমাহীন। নৈরাজ্যের আবহে বেআইনি ক্ষমতার ধারক-বাহকেরা তখন সিস্টেমের ইঞ্জিন হয়ে বসে। ক্ষমতা চায় আনুগত্য, চায় মানুষ ও সম্পদ নিয়ে লীলাখেলার স্বাধীনতা। এটা প্লাবনের মতো ছড়ালে ক্ষমতাহীন গরিব ও ছন্নছাড়া বেকারদের কেউ কেউ তাদের সঙ্গে শামিল হয়, অধিকারের বদলে অনুগ্রহধন্য হয়ে তারাও চায় ক্ষমতার ঝোলের স্বাদ। ক্ষমতাবানদের আশ্রয়ে এভাবে তারাও পরিণত হয় ‘ঘরোয়া শত্রুতে’। আজকে ঘরে-বাইরে মেয়েদের ওপর চড়াও হওয়া ‘বীরপুঙ্গবরা’ এমনই ঘরোয়া শত্রু হিসেবে হাজির হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে এক ভয়ের সংস্কৃতি। কারণ সরকার-প্রশাসন শিথিল, সমাজ প্রতিরোধহীন।
৬ এপ্রিলের প্রথম আলোর এক নিবন্ধে মোটামুটি এমন পরিস্থিতিকেই ‘তরল ভয়’-এর শিরোপা দিয়েছেন লেখক সুমন রহমান। এই ভয়ের সংস্কৃতি সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘কিছু ভয় আছে, যা পুরো প্রাকৃতিকও নয়, আবার পুরো সাংস্কৃতিকও নয়। এদের কোনো নাম নেই, এরা থাকে মাঝখানে ধূসর এলাকায়। এরা প্রাকৃতিক হলেও পুরোপুরি নয়, আবার মানবসৃষ্ট হলেও পুরোপুরি নয়। এই জোনে আপনার বিবেকবুদ্ধির বিশেষ ভূমিকা নেই, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রও এখানে কখনো বধির কখনো বা অকেজো...।’ এই বিশ্লেষণ থেকে মনে হতে পারে, সমাজ-রাষ্ট্রের নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনা নয়, নিরাপত্তা ও অধিকারের অভাব নয় এই ভয়ের কারণ কোনো গায়েবি উৎস। আর ‘অকেজো’ বলে সমাজ ও রাষ্ট্রও পেল ছাড়। তিনি বলছেন, ‘শ্রেণী-লিঙ্গ-বর্ণভেদে আগের মতো জমাট বাঁধছে না।’ অথচ সরকারসহ উচ্চ শ্রেণীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিপত্তির প্রশ্রয় ছাড়া কি এই সহিংসতা চলতে পারত? এই বিশৃঙ্খলার প্রধান সুফলভোগী কি তারাই নয়? আর নিম্ন ও মধ্যবিত্তই কি নয় এর প্রধান শিকার? এখানে আমরা আক্রান্ত হচ্ছি পুরুষালি-সন্ত্রাস তার ভাই-বেরাদর দখল-দুর্নীতি ইত্যাদির হাতে। এই ঘটনা ধরা যাক, ডেনমার্কে কিংবা ওমানে এভাবে ঘটছে না। এর নির্দিষ্ট দেশীয় ও সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক চেহারা আছে। ক্রসফায়ার কোনো গায়েবি সন্ত্রাস নয়। কিন্তু এসব তাঁর নজর এড়াল, ডন কুইকজোটীয় কায়দায় কাল্পনিক শত্রুর বিরুদ্ধে চালালেন অধিবিদ্যার তরোয়াল।
দৃশ্যমান কারণগুলো এড়িয়ে অজানা সমস্যায় পীড়িত হওয়া হাওয়ার ওপর তাওয়া ভাজা সমান কথা। সহিংস বাস্তবতাকে তারল্যে ভাসাতে গিয়ে তাঁকে একে একে ইতিহাস, সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি, রাজনীতি মায় পুরো বাস্তব জগত্টাকেই হিসাব থেকে বাদ দিতে হলো। এই হলো তাঁর ভয়ের অধিবিদ্যা।
সমস্যার সাগরে হাবুডুবু খেতে খেতে কূলকিনারা হারানো কেউ এভাবে ভাবতে পারে। সাবেক কালের রোগ-ব্যাধি, বালা-মুসিবত, দুর্ভাগ্যসহ নানান উদ্বেগে জর্জরিত নিয়তিবাদী মানুষ যেমনটা ভাবত। হলিউডি ভুতুড়ে ও থ্রিলার ছবির জগতেও স্নায়ু হিম করা ভয়ের কায়কারবার দেখা যায়। কিন্তু জীবনের সত্যিকার বিপদ নয় বরং ভিনগ্রহের প্রাণী, ভাইরাস, ডাইনোসর, তেলাপোকা, মুসলিম জঙ্গি কিংবা যেকোনো প্রাকৃতিক শক্তি মায় কবর থেকে ওঠা পিশাচসহ নানান বানোয়াট ভীতির জমজমাট রাজত্ব সেখানে। ছোটদের মতো বড়রাও আসক্ত হয়ে উঠতে পারে এসব রূপকথায়; কিন্তু তা পরিস্থিতি বদলের পথ দেখায় না। এভাবে বাস্তব দুনিয়ার বাস্তব অপশক্তিগুলোর দাবড়ানি ভুলে থাকতে পারলে মনের সাময়িক আরাম হয় বটে, কিন্তু জীবনের অশান্তি তাতে শান্ত হয় না। বরং ভয়ের কার্যকারণ আড়াল করে সমাজসচেতনতার চোখে ঠুলি পরায়।
কিন্তু বাংলাদেশে এ রকম কোনো অজানা ও রহস্যময় সমস্যায় আমরা ভুগছি না। আমাদের সমস্যা বাস্তব ও জমাট নৈরাজ্য, ‘তরল ভয়’ নয়। এর বিরুদ্ধে জমাট ও তীব্র সরিষাবাড়ীর বালিকা বিদ্যালয়গুলোর ছাত্রীদের প্রতিবাদ (৬ এপ্রিল, প্রথম আলো)। এ ধরনের ‘অপ্রাপ্তবয়স্করাই’ সরব হয়ে সময়ের আর্তনাদ সবার কানে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। নৈরাজ্যের শিকার তারাই বেশি। আজ তাদের ডাকে সাড়া দিতে না পারলেএকদিন নৈরাজ্যই রাজ্যহয়েযাবে।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.