মধ্যপ্রাচ্য-ইসরায়েলের হম্বিতম্বি by ইউরি আভনেরি

ইরান বিষয়ে ইসরায়েলের হুমকি-ধমকি অনেকটা বাচ্চাদের সেই খেলার মতো। ছোট কোনো শিশুর সঙ্গে তার থেকে বড় কারও ঝগড়া লেগে গেলে ছোটটি বলতে থাকে, ‘আমাকে ঠেকাও, না হলে কিন্তু আমি ওকে মেরে ফেলব।’ ইসরায়েল এখন গোটা দুনিয়াকে সেটাই বোঝাচ্ছে, ‘আমাকে ঠেকাও, নইলে...।’ এবং দুনিয়াও ঠেকাচ্ছে।


রাগচটা ও মাথা মোটা লোকের কাজ-কারবার সম্পর্কে আগাম কিছু বলা কঠিন। তার পরও আমার মত হচ্ছে, ইসরায়েল ইরানে বিমান হামলা করতে যাবে না। আমাদের সামরিক বাহিনীর সেই তাকদ আছে কি না, সে আলোচনায় আমি যাচ্ছি না। ২৮ বছর আগে যে পরিস্থিতিতে তারা ইরাকের পারমাণবিক রিঅ্যাক্টর ধ্বংস করেছিল, সেই পরিস্থিতি এখন নেই। অন্যদিকে, রাজনৈতিকভাবে এটা কি সম্ভবপর? এর প্রতিক্রিয়া কি সামাল দেওয়া যাবে?
ইসরায়েলের বুনিয়াদি সীমাবদ্ধতা হলো: আমেরিকার সম্মতি ছাড়া ইসরায়েল কোনো বড় আকারের সামরিক অভিযানে যেতে পারবে না। সব দিক দিয়েই ইসরায়েল আমেরিকার ওপর নির্ভরশীল। যে বিমানগুলো হামলায় ব্যবহূত হবে, সেগুলোর জোগান দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এগুলোর যন্ত্রাংশও দেয় তারা। এত লম্বা পথের মাঝখানে বিমানে জ্বালানি ভরতে হবে যুক্তরাষ্ট্রেরই তেলের ট্যাংকার থেকে। একই কথা আমাদের সব সামরিক সরঞ্জাম সম্পর্কেও সত্য। তহবিল থেকে শুরু করে সবকিছুই আসে আমেরিকা থেকে।
১৯৫৬ সালে আমেরিকার কথা না শুনে বেন-গুরিও ফ্রান্স আর ব্রিটেনের মদদে আরব দেশ আক্রমণ করেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ধমকে ১০০ ঘণ্টা না যেতেই তাকে অধিকৃত এলাকা ছেড়ে আসতে হয়। এর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অনুমতি ছাড়া ইসরায়েল কোনো যুদ্ধে যায়নি। ’৬৫ সালের ছয় দিনের যুদ্ধ, কিংবা ’৮৩ সালের প্রথম লেবানন যুদ্ধ, হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে দ্বিতীয় লেবানন যুদ্ধ, হামাসের বিরুদ্ধে গাজা যুদ্ধসহ কোনো যুদ্ধেই ইসরায়েল যেতে পারত না, যদি মার্কিন সম্মতি না পেত। আমেরিকা এগুলোকে ‘জঙ্গি ইসলামের’ বিরুদ্ধে তার অভিযানের অংশ মনে করে।
কিন্তু ইরানের বেলায় সেটা করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। কারণ তা রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে আমেরিকার জন্য বিপর্যয় নামাবে। ইরানিরাও সেটা ভালো করেই জানে। হামলা শুরু হলেই ইরান সংকীর্ণ হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেবে। এ পথ দিয়েই দুনিয়ার বিশাল পরিমাণ তেল সরবরাহ হয়। তেলের দাম আকাশে উঠবে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইউরোপ হয়ে চীন ও জাপান অবধি বিশ্ব অর্থনীতি ঝাঁকুনি খাবে। এমনিতে মন্দায় নিমজ্জিত বিশ্ব অর্থনীতি আরও ডুববে, বেকারত্ব ও দারিদ্র্য বাড়বে এবং দাঙ্গা ও দেউলিয়া হওয়ার ঘটনা হবে নিয়মিত।
কেবল স্থলবাহিনীর মাধ্যমেই ওই প্রণালিটি খোলা সম্ভব। কিন্তু আফগানিস্তান ও ইরাকে আটকে পড়া আমেরিকার বাড়তি সেনা কই? অন্যদিকে বিক্ষুব্ধ আরব ও মুসলিম জনগণ এ ঘটনায় ফেটে পড়বে। তাদের সামাল দেওয়া মার্কিনের তাঁবেদার শাসকদের পক্ষেও হবে কঠিন। ইরাক ও আফগানিস্তান নিয়ে মুশকিলে পড়া আমেরিকা আর একা হতে চাইবে না।
এই যদি হয় ঘটনা, তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল যুদ্ধের আয়োজন বন্ধ করছে না কেন? কারণ এতে তাদের লাভ আছে। ইসরায়েল ইরানের ধুয়া তুলে ফিলিস্তিনি সমস্যাকে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে চাপা দিতে পারছে। অন্যদিকে যুদ্ধের হুমকি দেখিয়ে আমেরিকা অন্য পরাশক্তিদের ইরানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপে রাজি করাতে চাইছে। কিন্তু বাস্তবে ইরানের সঙ্গে রাশিয়া, চীন ও ব্রাজিলের রয়েছে দারুণ অর্থনৈতিক সম্পর্ক। এ ধরনের অবরোধ তাই ইরানের অর্থনীতিতে বড় আঁচড় কাটবে না। ইরানিরাও থামাবে না পারমাণবিক বোমা বানানো। ইরানের সরকারি বা বিরোধী সবাই ভালো করে জানে, কেবল একটি পারমাণবিক বোমাই ইরানকে মার্কিন হামলা থেকে সুরক্ষা দিতে পারে। এ বিষয়ে সবাই একমত। এ রকম অবস্থায় হামলা হলে বিরোধীরাও আহমাদিনেজাদের পাশে দাঁড়াবে।
ইসরায়েল ঠিকই ভেবেছে। বড় আকারের সামরিক অভিযান ছাড়া ইরানকে থামানো সম্ভব নয়। ইরানকে বোমা বানানো থেকে বিরত করা যাবে না জেনেই আমেরিকা এখন অবরোধের কথা বলে সমঝোতার চেষ্টা করছে।
এ অবস্থায় ওবামা প্রশাসন ইসরায়েলকেই বোঝাচ্ছে, যদি ইরান তোমাদের অস্তিত্বের হুমকি হয়, তাহলে কেন ফিলিস্তিনিদের জমি ছেড়ে দিচ্ছ না। পশ্চিম তীর ছেড়ে দাও। আরব লিগের শান্তি প্রস্তাব মেনে নাও। তাহলে ইরাকে ও আফগানিস্তানে আমাদের জন্য পরিস্থিতি সহজ হবে। আর আরবদের সঙ্গে বিবাদ মিটে গেলে ইরান ফিলিস্তিন প্রশ্নে আরব সমর্থন কাড়তে পারবে না। এটা হলে ইরানেরও ইসরায়েলে হামলা চালানোর কোনো অজুহাত থাকে না। তার পরও যদি তোমরা পূর্ব জেরুজালেমে জোর করে বসতি গাড়ো, তাহলে বুঝতে হবে, আসলে পরিস্থিতি তোমাদের জন্য তত গুরুতর নয়।
ইসরায়েলি মিডিয়া ইরানকে এক মধ্যযুগীয় খ্যাপাটে দেশ হিসেবে দেখাতে চায়। অথচ প্রাচীনকাল থেকে খোমেনির সময় পর্যন্ত ইরানিদের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক ছিল। ইরাক যুুদ্ধে ইরান সহযোগিতা করেছে, আশির দশকে ইরাকের সঙ্গে যুদ্ধে ইসরায়েল ইরানকে অস্ত্র জুুগিয়েছে। ইরান আদিতম সভ্যতার পীঠস্থান। বেশ কয়েকটি মহান সভ্যতা এখানে বিকশিত হয়েছে। অনেক পণ্ডিতের মতে, ইহুদিধর্ম ইরানের জরথুস্ত্রর নীতি দিয়ে প্রভাবিত হয়েছে। আহমাদিনেজাদ যত উচ্চবাচ্যই করুন, ইরানের সত্যিকার শাসক হলেন সেখানকার ধর্মগুরুরা। তাঁরা খুবই সাবধানি ও নমনীয় নীতি নিতে আগ্রহী এবং এখন পর্যন্ত কোনো দেশে তাঁরা আক্রমণ চালাননি।
সুতরাং ইরানিরা যখন পারমাণবিক বোমা বানাবেই, তখন বিজ্ঞোচিত হলো সেই পরিস্থিতির জন্য তৈরি হওয়া। কেননা কিছুদিনের মধ্যেই ভারত-পাকিস্তানের মতো ক্ষমতার ভারসাম্য চলে আসবে এ অঞ্চলে। ইরান হয়ে উঠবে আঞ্চলিক পরাশক্তি। এর সঙ্গে শান্তিপূর্ণ আলোচনার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকা উচিত। তার আগে উচিত, ফিলিস্তিনি জনগণ ও সমগ্র আরব দুনিয়ার সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা।
কাউন্টারপাঞ্চ থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর ফারুক ওয়াসিফ
ইউরি আভনেরি: ইসরায়েলি লেখক ও শান্তিবাদী সংগঠক।

No comments

Powered by Blogger.