রম্য-রাজবাণিজ্য by সাইফুল আলম

কিসমিস এবার আমার পানে কিছুটা ধিক্কারের বাতাস ছুড়ে বলল, 'দোস্ত, সারা জীবন তোমার মধ্যে কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা দেখলাম না। সর্বদাই দৃষ্টিটা যেন নিম্নমুখী।' আমি ওর কথায় এক মিলিগ্রামও লজ্জা না পেয়ে বললাম, 'দোস্ত, বিষয়টাকে খোলাসা করেই বলো।


জানই তো টাকাপয়সা সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে মানুষ বেশিক্ষণ হজম করে রাখতে পারে না।' কিসমিস এবার তার অনুসন্ধানী দৃষ্টিটাকে কফি শপটার এদিক-ওদিক খানিকটা উড়ন্ত সার্ভে করে সেটা আমার দিকে বেলি ল্যান্ডিং করে বলল, 'দোস্ত, এটা হচ্ছে রাজবাণিজ্য।'

'হাঃ হাঃ, হিঃ হিঃ, হোঃ হোঃ'_ তিন মাত্রার স্বরলিপির ওপর রচিত তিনটি ভিন্ন সুরের অট্টহাসি দিয়ে কিসমিস আলী তার মনের উচ্ছ্বাসকে উদ্গিরণ করতে লাগল। আমার প্রিয় এ বন্ধুটিকে এর আগে কখনও এত হাস্য-পুলকিত হতে দেখিনি। ওর হাসির মূর্ছনা কিছুটা নিম্নগামী হলে শুধালাম, 'কী বিষয় দোস্ত, আজ হঠাৎ তোমাকে এত হাস্যমুখরিত দেখাচ্ছে কেন?' হাসির সুরের সঞ্চারিটা তখনও তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজে মৃদু মৃদু দোলা দিচ্ছিল। নিজেকে কিঞ্চিৎ সামলে নিয়ে ও বলল, 'দোস্ত, বাণিজ্য! বাণিজ্য! বিশেষ এক বাণিজ্যের কথা ভেবেই হাসছি।' আমি হতবাক হয়ে বললাম, 'সেকি! জীবনের অস্তাচলে দাঁড়িয়ে আবার কোন বাণিজ্যের ফাঁদ পাতলে। লাভ-লোকসানের কথাটা একবার ভেবে দেখেছ? আমার বাক্য সম্পাদনটা শেষ হতে ও বলল, 'দোস্ত, এ বাণিজ্যে কোনো লোকসান নেই। লাভ ডবল প্লাস। তাছাড়া এ বাণিজ্যে কোনো অর্থনৈতিক পুঁজিও লাগে না।'
_ 'সেকি! এ যুগে টাকার বস্তা ছাড়া কি কোনো বাণিজ্য হয় নাকি?' আমি যেন বিস্ময়কে জড়িয়ে ধরে জানতে চাইলাম। একটা কফি শপে বসে আমরা দু'জন আলাপে মশগুল ছিলাম। আমাদের সামনের কফির পেয়ালা দুটো অনেক আগেই শূন্য হয়ে গিয়েছিল। কিসমিসের পক্ষ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে বললাম, 'দোস্ত, আরেক পেয়ালা কফি চলবে, নাকি এবার উঠবে?'
_ 'না দোস্ত, তার চেয়ে আরও কিছুক্ষণ বসে চলো বাক্য রচনা করি।' আমি কিসমিসের স্বভাবটা ভালোভাবেই জানি। কোনো বিষয়ে আলোচনা শুরু হলে ও মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে একেবারে শিকড়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তাই প্রতিবাদ না করে বললাম, 'এবার তবে তোমার বাণিজ্য ভাবনাটা প্রকাশ করে ফেল। দেখি তোমার বিজনেস পার্টনার হয়ে শেষ বয়সে কিছু কামাতে পারি কি-না।' আমার বাসনার কথাটা ওর কানের কাছাকাছি যেতেই ও তার ফ্যাকাশে জিভের ডগাটা পৌনে তিন ইঞ্চি মুখের বাইরে বের করে দু'পার্টির দাঁতগুলো দিয়ে চেপে ধরল। আমি ওর জিভটা দেখে বললাম, 'কী হলো? আমি কি কোনো অপ্রাসঙ্গিক কথা পেশ করলাম?' ও এবার দৃশ্যমান জিভের ডগাটাকে ত্বরিত মুখগহ্বরে চালান দিয়ে বলল, 'দোস্ত, এ বাণিজ্য কোনো এক বিশেষ সম্প্রদায়ের জন্যই বরাদ্দ।' আমি ওর কথায় আরও দু'কেজি ওজনের বিস্ময়কে কণ্ঠে মাখিয়ে বললাম, 'সেকি! বাণিজ্য করতে আবার সম্প্রদায়ভুক্ত হতে হয় নাকি। তবে কি তুমি কামার, কুমার বা জেলে, ময়রার কথা বলেছ।' কিসমিস এবার আমার পানে কিছুটা ধিক্কারের বাতাস ছুড়ে বলল, 'দোস্ত, সারা জীবন তোমার মধ্যে কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা দেখলাম না। সর্বদাই দৃষ্টিটা যেন নিম্নমুখী।' আমি ওর কথায় এক মিলিগ্রামও লজ্জা না পেয়ে বললাম, 'দোস্ত, বিষয়টাকে খোলাসা করেই বলো। জানই তো টাকাপয়সা সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে মানুষ বেশিক্ষণ হজম করে রাখতে পারে না।' কিসমিস এবার তার অনুসন্ধানী দৃষ্টিটাকে কফি শপটার এদিক-ওদিক খানিকটা উড়ন্ত সার্ভে করে সেটা আমার দিকে বেলি ল্যান্ডিং করে বলল, 'দোস্ত, এটা হচ্ছে রাজবাণিজ্য।'
'সেটা আবার কী? আমি শুধালাম। ও বলল, 'বিষয়টা হলো রাজনীতিবিদদের বাণিজ্য। তা তুমি তো কোনোদিন রাজনীতির আশপাশে বিচরণ করনি বলেই জানি। তাই ওই ভাবনাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে শুধু অবলোকন করতে থাক। তুমি ডিসকোয়ালিফাইড।' আমি বললাম,
_ 'কিন্তু এতে তো মনোকষ্টটা আরও বাড়বে।' ও বলল, 'কষ্টটাকে হজম করতে না পারলে, পেটের বুদবুদটাকে আমার মতো অট্টহাসি দিয়ে বমি করে ফেলবে। কিছুটা স্বস্তি পাবে।' আমি যেন কিসমিসের সংবেদনশীল অস্থির বিবেকটা উপলব্ধি করতে পারলাম। তাই শান্ত কণ্ঠে বললাম, 'সারা বিশ্বেই তো এ রাজবাণিজ্য চলছে, তবে আমাদের দেশে যেন আনুপাতিক হারটা বেশি।'
_'হ্যাঁ, কোনোক্রমে যদি একটা নামি দলে নাম লেখাতে পার তবেই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয়ে গেল। তারপর ভাগ্যদেবীর কল্যাণে যদি দলে কোনো পদ অলঙ্কৃত করতে পার তবে তো সোনায় সোহাগা। কিসমিসের কথায় আমার আগ্রহটা যেন ঘোড়দৌড়ের গতি পেল, ত্বরিত শুধালাম,
'তারপর?'
'তারপর আর কি? চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, লাইসেন্সবাজি, পারমিটবাজি, তদবিরবাজি, নিয়োগবাজি, চোরাচালানবাজি, দখলবাজি ইত্যাদি যেন গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের মতোই রমরমা বাণিজ্য। পারলে অনেকে আবার মাল্টিন্যাশনাল বাণিজ্য করতেও ছাড়েন না।' কিসমিসের কথার ম্যারাথন রেসটা শেষ হতে আমি বললাম, 'কিন্তু সবাই যে বাণিজ্যবাজ তা বলতে পার না।'
'না-না-না তা বলতে চাই না। ভালো মানুষ অবশ্যই আছেন, তবে লোম বাছতে কম্বল উজাড় আর কি?' কিসমিসের উক্তিটা সমাপ্ত হতে আমি বললাম, 'কিন্তু দোস্ত, বাজিকরদের এ বাজিমাত তো আইনের চোখে দণ্ডনীয় অপরাধ।' আমার কথাটা কিসমিস না শোনার ভান করে অন্য প্রসঙ্গ টেনে বলল, 'দোস্ত, আরও দু'পেয়ালা কফির অর্ডার দিয়ে আমাদের এখানে বসে থাকার টেনিউরটা কিছুক্ষণের জন্য রিনিউ করা যাক। লক্ষ্য করেছ নিশ্চয় ইতিমধ্যে ওয়েটার ছেলেটা দু'বার আমাদের টেবিলের আশপাশে ঘুরঘুর করে গেছে। আমি ওর প্রস্তাবটাকে মেনে নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে আবার বললাম, 'আইন তো তার গতিতে চলবে।' ইতিমধ্যে ওয়েটার ছেলেটা আমাদের টেবিলে আরও দু'পেয়ালা কফি রেখে তাচ্ছিল্যের চাহনি দিয়ে চলে গেল। কিসমিস এবার তা কফির দ্বিতীয় পেয়ালাটায় প্রথম চুমুকটা দিয়ে বলল, 'এ ক্ষেত্রে দেশের আইন-আদালত যেন ঠুঁটো জগন্নাথের মতো অনেকটা অপারগ।' আমি এবার অসহায়ের সুরে বললাম, 'তবে এসবের সমাধানই-বা কী?' উত্তরে কিসমিস তার প্রাচীন ওষ্ঠ যুগলে খানিকটা আধুনিক হাসি ঢেলে বলল, 'দেখ দোস্ত, বদলে যাও আর বদলে দাও_ এ আহ্বানটা শুধু বিলবোর্ডে শোভা পেলেই হবে না। প্রকৃতপক্ষে নিজেরা বদলে গেলে আপনাতেই অনেক কিছু বদলে যাবে। আর শিশুকাল থেকেই বাচ্চাদের অন্তরে সততার বীজ রোপণ করে দিতে পারলে ফল শুভ হবে।
_ 'তুমি যথার্থই বলেছে।'
_ 'আর হ্যাঁ, শ্রী অনুকূল ঠাকুরের সে মহান বাণীটি আমাদের মনে রাখতে হবে যে, সাধু হও সাধু সেজো না।' আমি আর কোনো উত্তর দিলাম না। ইতিমধ্যে আমাদের কফির পেয়ালা দুটিও শূন্যগর্ভ হয়ে গিয়েছিল। তাই আর বিলম্বকে প্রশয় না দিয়ে দু'জনেই উঠে দাঁড়ালাম।

ডা. সাইফুল আলম : ডেন্টাল সার্জন, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
 

No comments

Powered by Blogger.