জাহাঙ্গীরনগর : শিক্ষার মর্যাদা সমুন্নত থাকুক by ড. আনোয়ার খসরু পারভেজ, বশির আহমেদ ও সিকদার জুলকারনাইন

নাজমুল হাসান তালুকদার, রেজাউল করিম তালুকদার, মোঃ কামাল হোসেন খন্দকার হাসান মাহমুদ, স্বাগতা সাঈদ, শেখ আদনান ফাহাদ দেশের অন্যতম প্রধান বিদ্যাপীঠ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। আন্দোলন, প্রতি-আন্দোলন, অবরোধ, কিছু শিক্ষকের ক্লাস পরীক্ষা বর্জন_ সব মিলে প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক সৌন্দর্যের ধারক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় তার স্বাতন্ত্র্য যেন হারাতে বসেছে।


সরকার, রাজনৈতিক দল, মিডিয়া, সুশীল সমাজ তথা আপামর জনসাধারণের কাছে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি যেন নেতিবাচকতার অপর নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। চার মাস ধরে নানা ঘটনাপ্রবাহে এই বিশ্ববিদ্যালয়টির যে ভাবমূর্তি জাতির সামনে উপস্থাপিত হয়েছে তা যেমন অনাকাঙ্ক্ষিত তেমনি ভীতিপ্রদ এবং একই সঙ্গে আপত্তিজনক। সংবাদমাধ্যমে যেভাবে জাহাঙ্গীরনগরের 'অচল ও স্থবির' চিত্র ক্রমাগত অঙ্কন করা হয়েছে তা-ও দুঃখজনক। নেতিবাচকতা যদি সবচেয়ে বড় সংবাদমূল্য হয়েও থাকে, ইতিবাচকতার উপস্থিতি যদি জোরালোভাবে প্রকট হয় তাহলে তাকে উপস্থাপন করাও কি গণমাধ্যমের কর্তব্য নয়?
চার মাসের আন্দোলনের বাস্তবতায় জাহাঙ্গীরনগরের পরিস্থিতি এখন নতুন মোড়ে ক্রমে আপাত 'স্থিতিশীল' রূপ পরিগ্রহ করেছে। উপাচার্য প্রফেসর ড. শরীফ এনামুল কবীরের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনের এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী আন্দোলনকারীদের তার অফিসে ডেকে নেন এবং যৌক্তিক পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে বিষয়টি সুরাহা করার আশ্বাস দেন। আন্দোলনকারীরা প্রধানমন্ত্রীকে কথা দিয়ে আসেন যে, তারা আন্দোলন প্রত্যাহার করবেন।
'জাহাঙ্গীরনগর' নাটকের শেষ পর্ব দেখার অধীর অপেক্ষায় সবাই। একদল যখন ভাবছে 'বিপ্লব' সফল, আরেক দল যখন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় ব্যস্ত, তখন আমরা লিখলাম জাতির উদ্দেশে। বর্তমান উপাচার্যের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন আচার্য। কিন্তু আমাদের কাছে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে সত্যিকার ঘটনাগুলো সবার সামনে উপস্থাপন করা। যারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন এবং যারা সিদ্ধান্ত অবলোকন করবেন উভয় দলেরই সত্য জানা জরুরি। আমাদের মতো অসহায় কিছু শিক্ষকের খোলা চিঠি সব সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলবে, তা ভাবা বোকামি ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু এই চিঠি যদি দায়িত্বশীলদের সত্য জানতে এতটুকু প্রেরণাও জোগায় তাহলেই আমাদের প্রচেষ্টা সার্থক।
দেশবাসী অবগত আছেন যে, গত ৯ জানুয়ারি ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের আহমেদ কতিপয় সন্ত্রাসীর নির্মম নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করেন। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে তদন্তসাপেক্ষে সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ৭ ছাত্রকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবন বহিষ্কার এবং ৬ ছাত্রকে দুই বছরের জন্য বহিষ্কার ও ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাদী হয়ে মামলা করেছে এবং কতিপয় দুষ্কৃতকারীকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করতে সহায়তা করেছে, যা কেবল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, বাংলাদেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ করেছে বলে আমাদের জানা নেই। এ ধরনের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়ায় শিক্ষার্থীরা আন্দোলন থেকে ঘরে ফিরে। কিন্তু কিছু শিক্ষক প্রায় চার মাস তাদের আওতাধীন ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রাখেন। এইচএসসি পরীক্ষা শিগগির শেষ হচ্ছে। অভিভাবকরা সন্তানের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য উদ্বিগ্ন হবেন। বর্তমান উপাচার্য আজ এক অনাকাঙ্ক্ষিত বাস্তবতার সম্মুখীন। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি করেছেন। আন্দোলনকারীরা অভিযোগ করেছেন শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে। বিভাগের চাহিদা মোতাবেক নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ায় শিক্ষকদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার কাজ দ্রুত হওয়ায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট শূন্যের কোঠায়।
বর্তমান উপাচার্য শিক্ষার্থীদের আবাসনের জন্য তিন বছরে তিনটি হল নির্মাণ করেন (একটি সম্পন্ন, দুটি নির্মিতব্য), যেসব বিভাগে শ্রেণীকক্ষের সংকট ছিল সেসব বিভাগে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেন, নতুন প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ ও একটি আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাগার নির্মাণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিগত আটত্রিশ বছরের ইতিহাসে কোনো উপাচার্যই এত স্বল্প সময়ে এত ইতিবাচক কাজ করতে পেরেছেন বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষকরাও স্মরণ করতে পারেন না। অনেক অন্যায়কে শক্ত হাতে দমন করেছেন তিনি। তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের ও আওয়ামী মতাদর্শের হওয়া সত্ত্বেও ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মীকে বিভিন্ন সময়ে বহিষ্কার করতে দ্বিধা করেননি।
প্রশ্ন হচ্ছে, উপাচার্যের পদত্যাগই কি সব সমস্যার সমাধান করবে? আর যে প্রক্রিয়ায় আন্দোলন চলেছে, অদূর ভবিষ্যতে এর যে পুনরাবৃত্তি ঘটবে না তার গ্যারান্টি কে দেবে? আমরা মনে করি, অযৌক্তিক এই আন্দোলনের রোগ জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত, যা একজন উপাচার্য নিরাময় করতে পারবেন না। বিভিন্ন মতাদর্শের শিক্ষক নিয়ে গঠিত শিক্ষক সমাজ যেসব অভিযোগ জাতির সামনে এনেছেন, তার তদন্ত করা উচিত। একই সঙ্গে অভিযোগের ভিত্তিও খতিয়ে দেখতে হবে।
এই প্রেক্ষাপটে শিক্ষার মর্যাদা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমুন্নত রেখে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত উপাচার্যের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করাকেই আমরা যুক্তিসঙ্গত মনে করি। তাতে দেশবাসীর কাছে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা যেমন বাড়বে তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়টিকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার পথও মসৃণ হবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।

লেখকবৃন্দ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক
 

No comments

Powered by Blogger.