বিদ্যুৎ-সংকট-বাংলাদেশ ব্যাংকের সৌরবিদ্যুতের উদ্যোগ by এ কে এনামুল হক

বহুদিন আগে পড়েছিলাম, ‘যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি/ আশু গৃহে তার দেখিবে না আর নিশিথে প্রদীপ ভাতি...।’ কবিতাটি কি কারও মনে পড়ে? আমার মনে হয়, এ কবিতাটি আমাদের সবারই কয়েকবার করে পড়া উচিত। বিশেষ করে, আপনি যদি সম্প্রতি বাড়ি তৈরি করে থাকেন নিজের বা অন্যের জন্য।


হ্যাঁ, আপনি যদি ঢাকায় বাড়ি নির্মাণকাজে জড়িত থাকেন, তাহলে এ কবিতাটি নির্মাতাদের পাঠ্য হওয়া উচিত ছিল।
দুর্ভাগ্য যে কবিতাটি আমাদের মনে আছে, কিন্তু মনে নেই রাজউক কর্তৃপক্ষের, বাড়ি নির্মাতাদের কিংবা বিদ্যুৎ বিভাগের।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান বাংলাদেশ ব্যাংকে সৌরবাতির ব্যবস্থা করেছেন। প্রায় এক কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে তিনি যে ব্যবস্থা করেছেন, তা যেমন প্রশংসনীয় তেমনি আতঙ্কজনকও বটে। তিনি বাহবা পেতে পারেন এ কারণে যে এমন একটি ব্যবস্থার কথা তিনি চিন্তা করেছেন। তিনি গভর্নর হওয়ার পর এক আলাপচারিতায় তাঁকে বলেছিলাম, বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে সরকারের উচিত সৌরবিদ্যুৎ ঋণের প্রবর্তন করা। গভর্নর হিসেবে তিনি যা করেছেন, তাতে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে মাত্র, আরও কিছু চিন্তা বাকি রয়েছে। এবার আসি আতঙ্কের বিষয়ে। এক কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পটি কি আদৌ করা উচিত ছিল? অনেকেই বলবেন না। কারণ, এর মাধ্যমে কয়টি বাতি জ্বলবে, কত মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে? কেউ কেউ এ রকমও বলবেন, এমন খরচ হলে তো কারও পক্ষে সৌরবিদ্যুৎ চালানো সম্ভব হবে না।
গ্রামের দেড় লাখ গরিব মানুষ তাঁদের বাড়ি আলোকিত করেছেন এ সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে। কত টাকা খরচ করেছেন তারা? যাঁদের মোট ভিটেমাটির দাম ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকার মধ্যে, তাঁরা ২০ থেকে ৪০ হাজার টাকা খরচ করে গ্রামীণ শক্তি বা এমন কোনো এনজিওর মাধ্যমে ২১ থেকে ৩০ শতাংশ সুদে টাকা নিয়ে এ কাজটি করেছেন বা করছেন। বিষয়টি কি আদৌ ন্যায়সংগত? বলা হয়, এক ইউনিট সৌরবিদ্যুতের খরচ ৪০ থেকে ৬০ টাকা।
যাঁরা ঢাকায় বাড়ি বানাতে ৫০ লাখ থেকে দুই কোটি টাকা পর্যন্ত খরচ করতে পারেন, তাঁদের বাড়িতে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার বাধ্যতামূলক হবে না কেন? ভাবতে পারেন, আমরা জাতি হিসেবে কতটা অধঃপতিত যে শহরের বাসিন্দাদের আরাম-আয়েশের জন্য, এসি ব্যবহারের জন্য বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি মূল্য ২.২৫ থেকে ৬.৫০ টাকার মধ্যে রেখেছি, আর গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বলছি ৪০ থেকে ৬০ টাকা হারে বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে!
ভারতের প্রায় সব রাজ্যেই ট্রাফিক বাতি সৌরবিদ্যুতে চলে। বিষয়টি কি আমাদের কিছু শিক্ষা দেয়? পৌর কর্তৃপক্ষ এবং সড়ক ও জনপথ কর্তৃপক্ষের জন্য বিষয়টি কি কিছু চিন্তার খোরাক দেয়?
প্রায় প্রতি এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ গ্যাসের মাধ্যমে উৎপাদন করতে আনুমানিক খরচ হবে ৭ থেকে ১০ কোটি টাকা। এ বিদ্যুৎ স্টেশনটি চালু রাখতেও খরচ রয়েছে। ছোট ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইউনিটপ্রতি উৎপাদন খরচ এখনো ৬ থেকে ১০ টাকার মধ্যে। বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধির আনুমানিক হার ১০ থেকে ১২ শতাংশ (প্রতিবছর)। এমতাবস্থায় প্রতি ৮-১২ বছরে বিদ্যুতের উৎপাদন দ্বিগুণ করতে হবে। অর্থাৎ প্রতিবছর ন্যূনতম ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ গ্রিডে সংযোজন করতে হবে। গত ১০ থেকে ১২ বছরে আমরা যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছি, তাতে বোঝা যায়, প্রতিবছর ৪০০ থেকে ৫০০ মেগাওয়াট অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন অন্তত বিদ্যুৎ বিভাগ করতে পারবে না।
বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে তাই সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে। কিন্তু গ্যাসের অপ্রতুলতা আর কয়লা উৎপাদনে প্রতিবন্ধকতার কারণে ব্যাপক সাফল্য লাভ করা সহজ হবে না। তবে উৎপাদন বাড়াতেই হবে। এ ক্ষেত্রে প্রচলিত উেসর পাশাপাশি অপ্রচলিত উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো যেতে পারে। কিন্তু যে খরচের হিসাব দেওয়া হলো, তাতে অন্তত বুদ্ধিমান কেউ এ কাজে আসবে না—আসবে গরিবেরা! আমাদের অভিজ্ঞতা তা-ই বলে। এত বেশি ব্যয় সত্ত্বেও গরিবেরা কেন সৌরবিদ্যুতের প্রতি আগ্রহী হলো? কারণ একটাই, তাদের কপালে বিদ্যুৎ বিভাগের বিদ্যুৎ নেই। তাই বাধ্য হয়ে তারা কাজটি করছে।
বিষয়টি একটু ঘুরিয়ে বলি। মনে করুন, বলা হলো, ঢাকার প্রতিটি বাড়ি যদি অন্তত ২০ শতাংশ বিদ্যুৎ সৌরশক্তির সাহায্যে উৎপাদন করতে না পারে, তবে বিদ্যুৎ বিভাগ বিদ্যুৎ-সংযোগ দেবে না। সে ক্ষেত্রে বিষয়টি কী হতো? কোটি টাকার অট্টালিকা বানাতে পারেন, সীমানা থেকে পাঁচ ফুট জায়গা ছেড়ে ঘরে একটু আলো-বাতাসের ব্যবস্থা করতে অনিচ্ছুক কেন? কারণ, বিদ্যুৎ সস্তা। বিদ্যুৎ সস্তা বলেই আমরা ঘরকে অন্ধকার বানিয়ে দিনরাত বাতি জ্বালাচ্ছি। আমাদের স্থপতিরা চিন্তা করতে পারছেন না যে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী বাড়ি কীভাবে বানানো যায়। তাঁদের চোখও সস্তা বিদ্যুতের দিকে। আজ যদি বাধ্যতামূলকভাবে কিছু ব্যবস্থা করা যায়, তবে বিদ্যুৎ-সংকট কিছুটা হলেও দূর করা সম্ভব। ভারতের বেঙ্গালুরু শহরে সোলার হিটার ছাড়া কোনো বাড়ি নেই। কারণ, তা বাধ্যতামূলক। জার্মানির বহু শহরে বাড়ি বাড়ি সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করে তা আবার গ্রিডেও সরবরাহ করা হয়।
বিদ্যুৎ উৎপাদন জাতীয় স্বার্থেই আমাদের করতে হবে এবং যেহেতু সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে কিছুটা হলেও বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে—সরকারের উচিত বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নেওয়া। এ প্রসঙ্গে আতিউর রহমান আশার কথা শুনিয়েছেন। বিষয়টি একটু সহজ করে বলা উচিত। আমি মনে করি, সব বাড়ির মালিককে সরকার এককালীন সৌরবিদ্যুৎ ঋণের আওতায় আনতে পারে। সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে আগামী ছয় থেকে ১২ মাসের মধ্যে বাড়িতে সৌরবিদ্যুতের আওতায় আনতে হবে। এতে খোদ ঢাকা শহরেই ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হয়েছে। যেহেতু এই ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরকারকে বা কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে উৎপাদন করতে হবে না, তাই এতে অনেক সাশ্রয় হবে। যেমন, গ্যাস সাশ্রয় হবে, সরকারের বিতরণ, উৎপাদন ও সঞ্চালন বিভাগের খরচ সাশ্রয় হবে। তাই সরকারের উচিত বিষয়গুলো বিবেচনায় এনে এ ঋণের সুদের হার প্রচলিত সুদের অর্ধেক বা আরও কম নির্ধারণ করা।
নতুন বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী বাড়ি তৈরিতে উৎসাহিত করার জন্য ব্যবস্থা নিতে পারে রাজউক। বাড়িতে ব্যবহারের অন্তত ২০ শতাংশ বিদ্যুৎ নিজেদেরই তৈরির ব্যবস্থা থাকা (সৌর বা বায়ুচালিত) বাধ্যতামূলক করতে হবে। যেসব বাড়ি বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী নয় বলে প্রতীয়মান হবে, এর অনুমোদন দেওয়া অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা উচিত। সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারের জন্য যন্ত্রপাতি আমদানির পদ্ধতি আরও সহজ করা উচিত। সে ক্ষেত্রে দাম আরও কমে আসবে।
ড. এ কে এনামুল হক: ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের পরিচালক।
akehaque@eco.uiu.ac.bd

No comments

Powered by Blogger.