চিরকুট-আইখম্যান by শাহাদুজ্জামান

সেসব দৃশ্য আমরা গল্পে পড়েছি, চলচ্চিত্রে দেখেছি, শুনেছি প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায়। তালিকা মিলিয়ে শহরের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ইহুদিদের ধরে এনে গাদাগাদি করে তুলে দেওয়া হচ্ছে মালগাড়ির বগিতে। দূরদূরান্ত পেরিয়ে সে গাড়ি এসে থামছে নির্জন প্রান্তরে।


বন্দীদের বলা হচ্ছে, এই প্রান্তরে কাজ করবে তারা কিন্তু কাজের আগে নিজেদের ধুয়েমুছে সাফ করে নিতে হবে। শত শত নারী-পুরুষ, শিশুকে বিবস্ত্র করে ঢোকানো হচ্ছে সারি সারি অলৌকিক স্নানঘরে। হতবিহ্বল রেলযাত্রীরা দীর্ঘ যাত্রার পর একটি নির্মল স্নানের আশায় ঢুকছে ওই অভূতপূর্ব ঘরগুলোতে। তারপর ওই নিশ্ছিদ্র স্নানঘরের ছাদ থেকে পানির বদলে আলতো করে পড়তে শুরু করছে বিষাক্ত গ্যাস। বদ্ধ সেই সব ঘরে আটকে পড়া মানুষেরা আর্তচিৎকার করছে, গোঙাচ্ছে। তারপর স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে একসময়। আমরা বাকরুদ্ধ হয়েছি। গ্যাস চেম্বারে স্বল্পতম সময়ে সর্বাধিকসংখ্যক মানুষ হত্যার ওই ভয়াবহ এবং অভিনব কৌশলের অন্যতম রূপকার এডলফ আইখম্যানের কথা মনে পড়ছে। গুরু এডলফ হিটলারের অন্যতম, বলা যায় যোগ্যতম শিষ্য তিনি।
হিটলারের কথায় মুগ্ধ হয়ে তেল কোম্পানির কেরানির চাকরি ছেড়ে নািস বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন আইখম্যান। উচ্চাকাঙ্ক্ষী, নিষ্ঠাবান কর্মী আইখম্যান নজর কাড়েন হিটলারের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়নি তখনো। ব্রিটেন তাদের প্যালেস্টাইন ম্যান্ডেট অনুযায়ী ইউরোপের ইহুদিদের প্যালেস্টাইনে অভিবাসনের উদ্যোগ নিচ্ছে। জার্মানি থেকে ইহুদিদের প্যালেস্টাইনে অভিবাসনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি হিটলার যে দুজন নািস কর্মীকে দেন তাঁদের অন্যতম আইখম্যান। এই সূত্রে জার্মানের সব ইহুদির যাবতীয় তথ্য সংগ্রহের সুযোগ পান আইখম্যান। জার্মানির ইহুদিসংক্রান্ত তথ্য-উপাত্তের বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন তিনি। ফলে পরবর্তীকালে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর হিটলার যখন ইহুদি নিধনের সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন স্বভাবতই এ কাজে প্রথম ডাক পড়ে আইখম্যানের। জার্মান তথা পৃথিবী থেকে ইহুদিদের নিশ্চিহ্ন করার দায়িত্ব দেওয়া হয় আইখম্যানকে। দায়িত্ব পেয়ে উদ্দীপনার সঙ্গে স্মরণাতীতকালের বীভৎসতম হত্যাযজ্ঞের মহাপরিকল্পনায় নেমে পড়েন তিনি। গ্যাস চেম্বারে ইহুদিদের হত্যার পুরো বিষয়টি তদারক করেন আইখম্যান। তিনি নিজ হাতে ঠিক করেন কোন অঞ্চলের, কোন ইহুদির, কখন কোন গ্যাসচেম্বারে মৃত্যু হবে।
কিন্তু ইতিহাস গুরু-শিষ্যের বিপক্ষে গিয়ে দাঁড়াল। পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে আত্মহত্যা করলেন গুরু এডলফ হিটলার। কিন্তু যুদ্ধের পর শিষ্য এডলফ আইখম্যানকে খুঁজে পাওয়া গেল না কোথাও। জানা গেল না তিনি জীবিত না মৃত। অথচ কয়েক কোটি মানুষ হত্যার তুখোড় এই নকশাবিদের হদিস পাওয়া না গেলে স্বস্তি নেই বিশ্ব বিবেকের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর পৃথিবীর মানুষের কৌতূহল তাই অব্যাহত রইল এই নিখোঁজ মানুষটিকে ঘিরে। গণমাধ্যম, গোয়েন্দা তৎপরতা, ব্যক্তিগত উদ্যোগ মিলিয়ে অবিরাম চলল এই অভিশপ্ত মানুষটিকে খুঁজে পাওয়ার অভিযান। তারপর এক এক করে যুদ্ধশেষের ১৫ বছর পর ১৯৬০ সালে হঠাৎ একদিন খোঁজ পাওয়া গেল আইখম্যানের। জানা গেল, যুদ্ধ থামার পর গোপনে ইতালিতে গিয়ে সেখান থেকে ছদ্মবেশে নকল পাসপোর্ট নিয়ে আইখম্যান পালিয়ে গেছেন সুদূর আর্জেন্টিনার বুয়েনস এইরেস। নতুন নাম নিয়েছেন রিকার্ডো ক্লেমেন্ট। সেখানে এক গাড়ি কোম্পানির ফোরম্যানের চাকরি নিয়েছেন তিনি এবং শুরু করেছেন খরগোশ পালন। পরাক্রমশালী মৃত্যুদূত যতই গোবেচারা খরগোশ পালক হয়ে থাকুক না কেন, কখন কোন অপ্রত্যাশিত রন্ধ্রপথে যে বেরিয়ে যাবে সত্যের সাপ, কেউ তা জানে না। আইখম্যানের ছেলের ইহুদি প্রেমিকা ঘটনাচক্রে জেনে যান তাঁর হবু শ্বশুরের গোপন পরিচয়। সে খবর প্রেমিকার বাবার মারফত চলে যায় জেরুজালেমে। তারপর দীর্ঘ গোয়েন্দা তৎপরতায় একদিন আটক হন ক্লেমেন্টের মুখোশের আড়ালের আইখম্যান। শুরু হয় যুদ্ধাপরাধের সবচেয়ে আলোচিত বিচার। কপট খরগোশপালক আইখম্যান দাঁড়ান সারা পৃথিবীর বিবেকের সামনে। অসংখ্য দলিল, অগণিত প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য, দীর্ঘ জেরার পর স্পষ্ট হয়ে ওঠে ইতিহাসের বৃহত্তম গণহত্যার নিপুণ কারিগরের যাবতীয় ইতিবৃত্ত। বিচারে মৃত্যুদণ্ড হয় আইখম্যানের। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে আইখম্যান বলেন, তিনি সবই করেছেন হিটলারের আদেশে। তবে তিনি স্বীকার করেন, যা করেছেন তা মনুষ্যত্বের অপমান। আইখম্যানের বিচার প্রমাণ করে, কী করে একজন মানুষ রণাঙ্গনে না গিয়ে, অস্ত্র হাতে না নিয়ে, একজনের গালেও ’চপেটাঘাত’ না করে হতে পারেন নিকৃষ্টতম যুদ্ধাপরাধী। আইখম্যানের গ্রেপ্তার ও বিচারের ওপর রচিত হয়েছে একাধিক বই, চলচ্চিত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীরা চোখের ভেতর উত্কট বালুকণার মতো অবিরাম যন্ত্রণা দিয়েছে ইউরোপকে। যুদ্ধাপরাধের একেকটি বিচার তাদের সেই চোখের বালু সরানোর উদ্যোগ, সেই যন্ত্রণা লাঘবের উপায়, সেই অপমানের উত্তর, যা অব্যাহত রয়েছে আজও।
একাধিক গবেষক উল্লেখ করেছেন পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গণহত্যা এবং নৃশংসতার মাত্রার দিক থেকে অন্যতম একটি ঘটনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু গণহত্যার অপরাধে অপরাধী সেই সব চোখের বালু আমরা চোখে নিয়েই বেড়িয়েছি দীর্ঘকাল। সেই বালুর আঘাতে আঘাতে চোখ আমাদের রক্তিম হতে হতে এখন অন্ধ হওয়ার জোগাড়। কালে কালে এমনই অনেক ভুলের পাহাড় জমেছে আমাদের। ফলে এমন নয় যে যুদ্ধাপরাধী এই সব চোখের বালু সরালেই আমরা সামনে দেখতে পাব সুবর্ণ গ্রাম, ধানে ভরে যাবে গোলা আর আলোয় ভরে যাবে ঘর। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাস আমাদের এই জানায় যে একটি জাতির এ ধরনের আবেগগত, নীতিগত ও চেতনাগত অমীমাংসিত সংকটের নিষ্পত্তি না হলে তার আর্থসামাজিক সংকট নিষ্পত্তিও মুখ থুবড়ে থাকে।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.