স্বীকৃতি-মানুষ যা মনে রাখার রাখে by আফজাল হোসেন

নবাব সিরাজউদ্দৌলা যাত্রা বা সিনেমা যাঁরা দেখেছেন, শেষের দিকের একটা করুণ দৃশ্যের কথা হয়তো অনেকের মনে আছে। পালিয়ে যাওয়ার সময় নবাব ধরা পড়েছেন, তার পরের দৃশ্য। একদল মানুষ দরবার সাজিয়ে বসে। নবাবকে হাজির করা হলো। শুরু হয় তাঁকে নিয়ে কুৎসিত রসিকতা।


পরিচয়ে সাধারণ সেই মানুষেরা নবাবকে জুতার মালা পরিয়ে দিতে চায়, কাঁটা দিয়ে তৈরি সিংহাসনে বসতে বলে। নবাবকে আহতস্বরে বলতে শুনি, আমি যে তোমাদের ভালোবেসেছিলাম তারই পুরস্কার কি জুতার মালা আর কাঁটার সিংহাসন?
দৃশ্যটায় দর্শকদের চোখে পানি এসে যায়। কেমন অবাক করা ঘটনা! একদল সাধারণ পরিচয়ের মানুষ নবাবকে অপমান করার জন্য তৈরি হয়ে বসে, অনেক অনেক বছর পর আরেক দল সাধারণ, সে দৃশ্য দেখে কাঁদো কাঁদো হন বা কেঁদেই ফেলেন।
এই দুই দল সাধারণে অনেক প্রভেদ। সিনেমা বা যাত্রায় অপমান দৃশ্যের দর্শক দল শুধুই সাধারণ, অন্য দলটি কম জোর সাধারণ থেকে কিনে নেওয়া।
যা-ই হোক, নবাব ধরা পড়ার পর এমন ঘটনা ঘটেছিল নাকি ঘটনা জমাতে এমন দৃশ্য লেখা হয়েছিল? সত্য বা কল্পনার হিসেবে না গিয়ে যেটা স্পষ্ট হয়, মান-মর্যাদাকে টেনেহিঁচড়ে ধুলায় নামানোর স্পৃহা পূর্বকাল থেকেই একশ্রেণীর মানুষের মনে ঘাপটি মেরে টিকে আছে। পলাশী, মুর্শিদাবাদ থেকে অনেক অনেক দূর এসেও তেমন মানুষের এমন মনোবৃত্তির সামান্য অদলবদল হয়েছে বলে মনে হয় না।
সাধারণ আর অসাধারণ মানুষে পার্থক্য আকাশ-পাতাল হলেও একজনকে ছাড়া অন্যজন অসম্পূর্ণ, শোভাহীন। এরা একে অন্যের জন্য, মেড ফর ইচ আদার।
সাধারণ অসাধারণকে মানে, সম্মান সমীহ করে এবং সাধারণই রয়ে যায়। অন্যদিকে অসাধারণ মানুষ অসাধারণত্বের তেজে সাধারণকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে না। এমন বোঝাপড়া, একে অন্যের ওপর ভরসা রেখে চলার এ সরল নিয়মে সভ্যসমাজ ভেসে চলছে, আশার ভেলায়।
আশা মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দুই অক্ষরের এই সামান্য শব্দ, পার্থক্য নির্ণয় করে দেয় সাধারণ আর অসাধারণের। হতাশাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে আশায় বাঁচে সাধারণ। অসাধারণ মনে হতাশার ঠাঁই নেই। আশার আকৃতি, রূপ বর্ণনা করতে পারেন অসাধারণ। যে মনে আশা নিরাকার, সে মনে আশা আকারপ্রাপ্ত হলে অসাধারণের অসাধারণত্বকে না মেনে উপায় থাকে না ।
সাধারণের সাধারণত্ব হচ্ছে, নানা প্রকার ভোগান্তিকে অদৃষ্ট মনে করে মেনে নেয়। ক্ষমা করতে জানে, ধৈর্যশীল। ঝড়-ঝাপটায় বিপর্যস্ত হয়, নুয়ে পড়ে, কিন্তু টিকে থাকে।
দেশের জন্য সাধারণেরা অসাধারণ হয়ে উঠেছে অনেকবার। ভাষার অধিকারে-সংগ্রামে নেমেছে, প্রাণ দিয়েছে। স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়েছে, উজাড় হয়েছে সাধারণ। গণতন্ত্রের জন্যও জীবন দিতে কুণ্ঠিত হয়নি। প্রয়োজনে জ্বলে ওঠা, তারপর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে আবার নিভু নিভু সাধারণ বনে যাওয়া এই হচ্ছে সাধারণের অসাধারণত্ব। সাধারণেরা সাধারণ থাকতেই ভালোবাসে।
এমন সহজ-সরল আচরণকে দুর্বলতা ধরে নেওয়া যায়, তা অতি দরিদ্র বিবেচনা। মানুষেরা ভাবনায়-চিন্তায় খুবই স্বাধীন বলে কল্পনায় যে কেউ বিনা পয়সায় অসাধারণ বনে যেতে পারে। জোর-জবরদস্তিতে অসাধারণ হওয়া সম্ভব নয়, কল্পনায় খুবই সম্ভব। সাধ্য নেই তবু মনে অসাধারণত্বের বাসনা, একই সঙ্গে মনে খামতির খচখচানিও। এই ত্রিশঙ্কু অবস্থার যে অদৃশ্য অস্থিরতা তার ফল ভোগ করতে হয় বেচারা সাধারণকেই।
অসাধারণত্ব, অমরত্ব এসব লাভের আশা অনেক মানুষের আছে, থাকবে। অসাধারণত্বের খায়েশ জাগলে চোখ অন্ধ হতে শুরু করে, শ্রবণশক্তি কমে আসে, ঘ্রাণেন্দ্রিয়ও হয়ে আসে ভোঁতা। সত্য মিথ্যা, স্বাভাবিক অস্বাভাবিক এসব মাপামাপির বোধযন্ত্র বিকল হয়ে পড়ে অব্যবহারে।
গায়ের জোরে অসাধারণ হওয়ার সুযোগ নেই। এমন আশা পূরণ ডাল-ভাতের মতো নয়। যে প্রকৃত সাধারণ সে জানে অসাধারণত্ব ছেলের হাতের মোয়া নয়। তোষামোদিতে, অন্ধ হাততালিতে, উন্মাদ যুক্তিতে কে কবে কাকে অসাধারণ বানাতে পেরেছে? অর্থ, বিত্তবৈভব, উঁচু পদ কিংবা একগাদা অধস্তনে পরিচয়ের ভার বাড়ে কিন্তু এসবের কোনটা কাউকেও অসাধারণ বানাতে অক্ষম।
সাধারণ, অসাধারণ উভয়েই দুঃখ পায়। একজন সহসা দুঃখে আক্রান্ত হয়, অন্যজন দুঃখ পাওয়ার প্রকৃতই কোনো কারণ আছে কি না সে বিশ্লেষণ আগে করে নেন। সহজে এবং সহসা ক্রোধে অন্ধ হওয়া, অভিমানে আপ্লুত হওয়া, হিংসায় জ্বলে প্রতিহিংসায় পোড়াতে চাওয়া অসাধারণত্বের লক্ষণ নয়।
অসাধারণ হুল্লোড় করেন না, আদেশ করেন না। চোখ রাঙানো, জোর খাটানো অসাধারণের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নয়। পেশিশক্তিকে বোকামো মনে করেন অসাধারণ। অসাধারণ লড়াকু নয়, বিশ্বাস করেন জীবন-সংগ্রামে। সংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধাশীল কিন্তু পরিবর্তন আনতে চান চেতনায়। তাই অসাধারণের ঢাল কিংবা তলোয়ারের প্রয়োজন পড়ে না, পোষ্য বাহিনীর দরকার হয় না। অসাধারণ অস্ত্র শানান না, আঁটঘাট বাঁধেন চিন্তায় ও মননে। কোমর বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়েন না অসাধারণ। দল পাকান না, আক্রমণ করেন না। উল্লাস করেন না। অসাধারণের উচ্ছ্বাস উচ্চকিত নয়। অসাধারণ নিজেকে ভাগ্যাহত মনে করেন না। নিজেকে দুর্বল বিবেচনা করেন না, মানুষের দুর্বলতা বোঝেন এবং জানেন। তিনি মানুষ তাই নিজে ত্রুটিহীন নন, তাও জানেন। অন্যের দুর্বলতা জেনে সমব্যথী হন, মানুষের ত্রুটি বড় করে দেখে আত্মপ্রসাদ অনুভব করেন না।
অসাধারণ যে মানুষ, তাকে কোনো সাধারণের পক্ষে সাধারণ বানানো সত্যিই সম্ভব নয়। শুধু কর্মে তো ওই আসন মেলে না, বিনা পানিতে কর্ম ও ধর্মকে মেলানোর গুণ থাকতে হয়।
অসাধারণদের সাধারণে নামিয়ে আনার চেষ্টা জগতে রয়েছে, থাকুক। নিয়ম অনুযায়ী আলোর নিচেই থাকবে অন্ধকার।
নবাব সিরাজউদ্দৌলা সিনেমা বা পালার শেষ দিকটা ধরা যাক, আয়োজন করে অপমান করা হয়েছিল তাঁকে। জোর অপমানেও মন ভরেনি, নিকটের মানুষ দ্বারা নিহতও হয়েছিলেন নবাব। নিঃশেষ হয়ে যাননি। এত এত বছর পরও মানুষের মনে শেষ নবাব এখনো সসম্মানে টিকে আছেন। মানুষ যা মনে রাখার রাখে, যেটা ফেলে দেওয়ার ফেলে দেয়।
আফজাল হোসেন: লেখক, অভিনেতা, বিজ্ঞাপনচিত্র-নির্মাতা।
afzalhossain1515@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.