সপ্তাহের হালচাল-একটি কার্যকর সমঝোতার সন্ধানে by আব্দুল কাইয়ুম

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একবার নরম আরেকবার গরমে চলছেন। বিদ্যুৎ-সংকট মোকাবিলায় তিনি দেশবাসীর কাছে সময় চেয়ে গত বুধবার যে নমনীয়তা দেখিয়েছেন, চার দিন না যেতেই জাতীয় সংসদে সাংসদদের ভাতা বৃদ্ধির ব্যাপারে বিরোধী দলের প্রতিবাদী ভূমিকাকে ‘স্ট্যান্টবাজি’ আখ্যায়িত করে তিনি ঠিক এর বিপরীত ভূমিকায় নামলেন।


অবশ্য প্রধানমন্ত্রী সোমবার সংসদ অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে বিদ্যুৎ-সংকটে ধৈর্য ধারণের জন্য আবার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু বিরোধী দলের বিরুদ্ধে টীকা-টিপ্পনী কাটতেও তিনি দ্বিধা করেননি। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী এনামুল হকের চিঠিতে সরকারদলীয় ও বিরোধীদলীয় সাংসদদের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। সহযোগিতা পেতে হলে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির দায়িত্ব যে সরকারি দলের ওপরই বর্তায়, সেটা তাঁরা ভুলে যান কী করে? গ্যাস-বিদ্যুতের ঘাটতির জন্য সব দোষ তাদের ওপর চাপিয়ে কি সরকার পার পাবে? বিএনপির দায় যদি পাঁচ বছরের হয়, তাহলে সোয়া এক বছরের দায় তো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে নিতে হবে। ‘নিজের বেলায় আঁটিসাঁটি, পরের বেলায় চিমটি কাটি’ নীতি তো চলে না।
সমস্যা কোথায় নেই। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কথাই ধরুন। একের পর এক খুনের ঘটনায় মানুষ উদ্বিগ্ন। ব্যবসায়ী খুন হন, শিক্ষকও খুন হন। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে মেয়ের বাবা-মাকে সাতসকালে গুলি করে খুনের ঘটনাও ঘটেছে। ছাত্রীদের পেছনে বখাটেরা লেগে থাকে। তাদের উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে ছাত্রী আত্মহত্যা করে। ছাত্রলীগের উচ্ছৃঙ্খল নেতা-কর্মীদের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী বারবার সতর্কবাণী উচ্চারণ করছেন। কিন্তু ওই সব সতর্কবাণীতে কেউ কান দিচ্ছে না। ‘আদু ভাই আর আংকেলদের’ দিয়ে ছাত্রলীগ হবে না বলে তিনি সিলেটে শনিবার যে মন্তব্য করেছেন, এর পরদিনই চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কক্ষে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন। তাঁদের দাবি, শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতার মানদণ্ড কমাতে হবে! তাঁরা কি পড়াশোনা করেন, না শিক্ষক নিয়োগের ব্যবসা করেন? তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মকর্তাকে মারধর করেছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষাঙ্গনের উপদ্রব এই ‘আদু ভাইদের’ বশে আনার কাজটি যে মাথায় হাত বুলিয়ে হবে না, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
সরকার একা কয়টা সমস্যা সামলাবে? সেদিক থেকে দেখলে বলা যায়, বিদ্যুৎ-সমস্যা মোকাবিলায় জনসাধারণ ও বিরোধীদলীয় সাংসদদের সহযোগিতা চেয়ে প্রধানমন্ত্রী একটি ভালো উদাহরণ স্থাপন করেছেন। তবে শুধু মুখের কথায় তো কাজ হবে না। সরকারের আন্তরিকতাও দেখাতে হবে। প্রথম কাজ হবে বিরোধী দলের ব্যাপারে সরকারের সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে রাজনৈতিক সম্পর্ক এত তিক্ত ও জটিল যে তাদের মধ্যে স্বাভাবিক কথাবার্তা ও মতবিনিময়ের পরিবেশ ফিরিয়ে আনাও এক দুরূহ কাজ। আওয়ামী লীগ মনে করে, বিএনপি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সুবিধাভোগী দল, তাই তাদের কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। বিএনপির জন্মলগ্ন থেকেই আওয়ামী লীগের এ রকম মনোভাব কাজ করছে। এটা ঠিক না ভুল, সে বিবেচনায় না গিয়েও আমাদের দেখতে হবে, এ রকম কঠোর মনোভাব সত্ত্বেও বিএনপির ব্যাপারে আওয়ামী লীগের দৃষ্টিভঙ্গির কৌশলগত পরিবর্তন সম্ভব কি না।
দুটি দলের মধ্যে আদা-কাঁচকলা সম্পর্ক থাকলেও আমরা দেখেছি, নিকট-অতীতে কতগুলো ঐতিহাসিক মুহূর্তে তারা রাজনৈতিক সহযোগিতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এরশাদের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন দুই জোটের ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর চূড়ান্ত পরিণতি ছিল নব্বইয়ের সফল গণ-অভ্যুত্থান। আরেক ঐতিহাসিক মুহূর্ত আসে একানব্বইয়ের নির্বাচনের পর। গণতন্ত্রে উত্তরণে তিন জোটের রূপরেখায় রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে সার্বভৌম সংসদ প্রতিষ্ঠার কথা ছিল। সংসদে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অভিন্ন অবস্থান ছাড়া এটা সম্ভব ছিল না। কিন্তু সে সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই মেরুতে। একে অপরের মুখ-দেখাদেখিও বন্ধ। দমবন্ধ অবস্থার মধ্যেও দুই দল এক হয়ে দ্বাদশ সংশোধনী পাস করে, ফলে সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়।
১৯৯৪ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে বিরোধী দলের সদস্যরা সংসদ থেকে একযোগে পদত্যাগ করলে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি একতরফা নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে। মাত্র দেড় মাস স্থায়ী এই ষষ্ঠ সংসদে বিএনপি সংবিধান সংশোধন করে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করে, তা সে সময়ের নির্বাচন বর্জনকারী আওয়ামী লীগ বাইরে থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন করেছিল। বিএনপি সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস করে ৩১ মার্চ পদত্যাগ করে। আওয়ামী লীগের সম্মতি না থাকলে ওই বিল বিএনপি পাস করত না। এতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করত। মূল দুই দলের মধ্যে একটি কার্যকর সমঝোতার ফলেই সংকট এড়ানো সম্ভব হয়েছিল।
সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ শেষে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির একযোগে অংশগ্রহণও ছিল একটি তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ। দুই দল রাজি না হলে হয়তো নির্বাচন অনিশ্চিত হয়ে পড়ত। তার মানে সেনা-সমর্থিত অন্য কোনো ব্যবস্থা দীর্ঘায়িত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হতো। শেষ পর্যন্ত তাদের সুমতি হলো। দুই দলের নেতৃত্বে দুই জোট ও মহাজোট নির্বাচনে অংশগ্রহণে রাজি হওয়া মাত্রই দেশের রাজনীতিতে প্রাণ সঞ্চারিত হলো। সংকটমুক্ত গণতন্ত্র গতি লাভ করল।
দেখা যাচ্ছে, গত দুই দশকে অন্তত চারবার আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখন আবার সে রকম একটি মুহূর্ত উপস্থিত, যখন এই দুই দলের মধ্যে একটি কার্যকর সমঝোতা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যদি এই প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করে চলতে চায়, তাহলে বিগত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে, তা অনেকখানি অবাস্তবায়িত থেকে যাবে।
সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে সম্পর্ক যত তিক্ত হোক না কেন, স্বাভাবিক কথা-চালাচালি না থাকলে চলে না। পরস্পর দুই বিপরীত মেরুতে অবস্থান করেও দুই পক্ষের মধ্যে চলনসই সম্পর্ক অব্যাহত রাখার কতগুলো কৌশল আছে। এ ব্যাপারে থাইল্যান্ডের সাম্প্রতিক সরকারবিরোধী আন্দোলনের অভিজ্ঞতা এখানে আলোচনা করা যায়। সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনের দাবিতে প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে বিরোধী দল ব্যাংককে সমাবেশ-মিছিল করছে। এরা সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার সমর্থক। এসেছে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে। লাখ খানেক তো হবেই। তাদের সমাবেশ চলছে শান্তিপূর্ণভাবে। কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা এখনো ঘটেনি। পুলিশও শান্ত। একপর্যায়ে বিরোধী দল প্রধানমন্ত্রী অভিজিত্ ভেজ্জাজিভার বাসা ঘেরাওয়ের কর্মসূচি দেয়। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী সংঘাতে না গিয়ে বাসা ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। মিছিলকারীরা এক অভিনব কর্মসূচি নেয়। তারা কর্মীদের রক্তদানের আহ্বান জানায়। নিজেদের গায়ের রক্ত কয়েকটি জারে ভরে তারা নিয়ে যায় প্রধানমন্ত্রীর বাসার দিকে। সংঘর্ষে না গিয়ে তারা পুলিশের অনুমতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বাসার সদর দরজায় রক্ত ঢেলে দেয়।
বিরোধী দলের অব্যাহত আন্দোলনের মুখে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। টিভিতে তা সরাসরি প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই সে বৈঠক শেষ হয়। বিক্ষোভ এখনো চলছে। এ পর্যন্ত কোনো অঘটন ঘটেনি। শেষ পর্যন্ত যদি শান্তিপূর্ণ মীমাংসা সম্ভব হয়, তাহলে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সমঝোতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপিত হবে।
বাংলাদেশে বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নির্বাচিত হয়েছে। তাই থাইল্যান্ডের পরিস্থিতির সঙ্গে এ দেশের অবস্থার তুলনা চলে না। কিন্তু সেখানে বিরোধী দলের প্রতি বা তাদের ক্ষোভ-বিক্ষোভের প্রতি সরকারপক্ষ যে নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করছে, তা বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। সব দেশে সব ব্যাপারেই যে ওরকম হতে হবে, তা নয়। কিন্তু পারিপার্শ্বিক ঘটনা থেকে আলাদা করে শুধু প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো আমরা বিবেচনার কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করতে পারি। বিশ্বের বিভিন্ন ঘটনা থেকে অভিজ্ঞতা গ্রহণের এটাই পরীক্ষিত পদ্ধতি।
রাজনীতি সরল পথে চলে না। প্রতিপক্ষের সঙ্গে যত সংঘাতই থাকুক, সংঘাত পরিহারের জন্য বিভিন্ন সময় সমঝোতা করতে হয়। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এটি একটি সুপরিচিত কৌশল। এখন সে রকম একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত এসেছে, যখন সমঝোতার মনোভাব নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে এগিয়ে আসতে হবে।
কিন্তু কীভাবে? এর একটি সহজ উপায় আছে। সরকারি দল আওয়ামী লীগ উদ্যোগী হয়ে বিএনপির সঙ্গে চার দফা যৌথ অঙ্গীকার সম্পাদনের জন্য আলোচনা শুরু করতে পারে। এই অঙ্গীকারনামার মেয়াদ হবে অন্তত আগামী ১০ বছর। অঙ্গীকারের প্রথম দফা হবে পরস্পরের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক, কটুকথা ও মন্তব্য বন্ধ রাখা। দ্বিতীয়ত, বিদ্যুৎ-গ্যাসসহ জাতীয় জ্বলন্ত সমস্যাগুলোর সমাধানে দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে একটি অভিন্ন নীতিগত অবস্থান গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নে পারস্পরিক সহযোগিতা। তৃতীয়ত, সংসদ কার্যকর করা। এবং চতুর্থত, জাতীয় অর্থনীতির কথা চিন্তা করে আগামী ১০ বছর হরতালের মত কর্মসূচি পরিহার করে বরং সংসদকে প্রতিবাদের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা।
দেশের মানুষকে স্বস্তি দিন। দেশটাকে শান্তিতে থাকতে দিন।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.