সময়চিত্র-স্বাধীন দেশ, পরাধীন মন by আসিফ নজরুল

বাঙালি মধ্যবিত্তের পরাধীন মন নিয়ে অনেক কথা হতো একসময়। এ নিয়ে লিখেছেন দুই বাংলার নামী কয়েকজন লেখক। এখন অবস্থা বদলেছে কিছু ক্ষেত্রে। এই বাংলার মানুষ স্বাধীন দেশ পেয়েছে। মধ্যবিত্তের আকার বেড়েছে বহু গুণ, কেউ কেউ নানা উপায়ে বিপুল সম্পদের মালিকও হয়েছে। এখন পরাধীনতা থাকার কথা নয় আমাদের।


কিন্তু এখনো বাঙালি মধ্যবিত্তের সবচেয়ে সুবিধাভোগী অংশের মধ্যে রয়েছে ঔপনিবেশিকতার ভূত, মানসিক পরাধীনতার শৃঙ্খল। মাঝেমধ্যে তা এতই প্রবল যে মন খারাপ করে বসে থাকতে হয় অনেকক্ষণ।
পরাধীন মানুষের দেশপ্রেম কম থাকে। আত্মসম্মানবোধ সম্ভবত আরও কম। অথচ সরকারে হোক সরকারের বাইরে হোক, পরাধীন মানুষেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। দেশে এদের দম্ভ আর দাপটের শেষ নেই। কিন্তু সব দাপট, সব আত্মসম্মান ম্লান হয়ে যায় অন্য জায়গায়। উপসচিব বা যুগ্ম সচিব মর্যাদার বিদেশি দূতের কাছে এরা নতজানু হয়ে থাকে, বিদেশে সামান্য খাতির পেলে এরা ধন্য হয়ে যায়, নিম্নশ্রেণীর বিদেশি পরামর্শকদের এরাই মাথায় তোলে। বিদেশের টাকায় নিজের দেশের দোষত্রুটি ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে সারা বিশ্বে এরাই প্রচার করে। বিনিময়ে পুরস্কৃত হয় ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবদ্ধভাবে। ডুবিয়ে দেয় দেশকে।
পরাধীন মানুষ নিজ দেশের মানুষের স্বার্থ নিরাপদ করতে পারে না। পারে না দেশের সম্পদ রক্ষা করতে। দেশের গ্যাস বিদেশিদের কাছে রপ্তানি করার সার্টিফিকেট এরাই দিয়েছিল। প্রকৌশলী শহীদুল্লাহ্ আর আনু মুহাম্মদের মতো দেশপ্রেমিক মানুষ না থাকলে, তাঁদের আন্দোলন না থাকলে এরা তখনই সফল হতো। পরাধীন মানুষ দেশের পানিসম্পদ উজাড় করার ভারতীয় প্রকল্পে সমর্থন দেয়। বিদেশিদের বক্তব্য স্বদেশি কণ্ঠে প্রচার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালায়। পরাধীন মানুষ ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কাছে বেহাত হওয়া হাজার কোটি টাকার সম্পদ ফেরত চাইতে ভুলে যায়, গণহত্যার জন্য ক্ষমা দাবি করার গুরুদায়িত্ব বিস্মৃত হয়। পরাধীন মানুষ ১৯৭৫ সালের নির্মম হত্যাকাণ্ডে অন্য সবার ভূমিকার কথা বলে, বলতে ভুলে যায় বিদেশি যড়যন্ত্রের কথা।
পরাধীন মানুষ স্বাধীনতার চেতনার কথা বলে। কিন্তু ব্যর্থ হয় নিজেকে স্বাধীন করতেই। দেশপ্রেমের কথা বলে। কিন্তু ব্যর্থ হয় দেশপ্রেমের মানে বুঝতে, নিজের দেশের মানুষের পাশে এসে দাঁড়াতে।

২.
পরাধীন মানুষ সবচেয়ে নির্মম ব্যর্থতা দেখায় দেশের মানুষের জীবন রক্ষার ক্ষেত্রে। এমনই এদের পরাধীন মন, দেশের সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করতে পারে না এরা সজোরে। সীমান্তে দেশের মানুষ খুন হলে এরা বড়জোর দুঃখিত হয়। ইসরায়েল-পশ্চিম তীর সীমান্তে এখন খুন হলে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে মানুষ। আমেরিকা-মেক্সিকোতে তা হলে আমেরিকাতেই ওঠে প্রতিবাদের ঢেউ। খুন হওয়া দেশের সরকার প্রতিবাদ করে, ক্ষোভ জানায়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে প্রতিকার চায়। আমাদের পরাধীন কর্তারা অধিকাংশ সময় নির্বিকার থাকে, মাঝেমধ্যে কেবল দুঃখিত হয়। ছোট দেশ, কর্তাদের কিছু সীমাবদ্ধতা হয়তো রয়েছে। কিন্তু নাগরিক সমাজ! তার বৃহত্তর অংশও চেপে যেতে চায় এই বৈরিতা, পারলে সেদিনও অপ্রাসঙ্গিকভাবে স্মৃতিচারণা করে বন্ধুত্বের।
বিএসএফ বা ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে নিহত হচ্ছে সীমান্তের গ্রামগুলোর দরিদ্র ভারতীয় নাগরিকেরাও। এদের বিরুদ্ধে সোচ্চার রয়েছে বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ, সংযোগ, এসডিটিসি, এসপিএমইউএম, বিএপিইউয়ের মতো অনেক ভারতীয় মানবাধিকার সংস্থা। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানবাধিকার সংগঠনের ভ্রুক্ষেপ নেই এই মানবতাবিরোধী অপরাধের দিকে। কেউ কেউ হত্যাকাণ্ডের তালিকা করে পাঠায় সংবাদপত্রে। কোনো কোনো পত্রিকার ইচ্ছেই হয় না এই সংবাদ ছাপার!
সীমান্তে বিএসএফের হত্যাকাণ্ডের ওপর প্রামাণ্য রিপোর্ট করেছিলেন লন্ডনভিত্তিক চ্যানেল ফোরের জোনাথন রাগম্যান। এই রিপোর্ট করেন তিনি ২০০৯ সালের আগস্টে। পরম বন্ধু দুই সরকার তখন দুই দেশে। অথচ এরই মধ্যে আধা বছরে খুন হয়েছে ৬০ জনের বেশি বাংলাদেশি। রাগম্যানের বর্ণনা: ‘যে তিনটি গ্রামে আমরা গিয়েছি, স্থানীয় লোকেরা ভিড় জমিয়েছে তাদের মৃত স্বজনদের ছবি নিয়ে। ক্যামেরার সামনে বারবার বলতে চেয়েছে, কতজন কৃষক আর রাখাল মারা গেছে বিএসএফের গুলিতে।’
রাগম্যান ভারতীয় কাঁটাতারের বেড়ার ছবি তুলেছেন, বিএসএফ গার্ড পোস্টের উঁচু করা বন্দুক দেখিয়েছেন, গুলিবিদ্ধ মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। আমাদের সাংবাদিকদের কাছেই ভিড়তে দেওয়া হবে না এসব রিপোর্ট করতে। কিন্তু আমাদের কলামিস্ট আছেন, আলোচক আছেন, টক শো আছে, সেখানে এর প্রতিবাদ হয় কালেভদ্রে। এমনকি সেখানেও বিস্ময়করভাবে বলে ওঠেন কেউ কেউ: অবৈধভাবে বাংলাদেশের মানুষ সীমান্ত পার হয় বলেই নাকি বিএসএফ গুলি করে!
অবৈধভাবে সীমান্ত পার হতে গেলে আর কোনো দেশের সীমান্তরক্ষীরা গুলি করে বিনা নোটিশে? ইসরায়েল-পশ্চিম তীর বাদে আর কোনো সীমান্তে গুলিবিদ্ধ হয় এত মানুষ? কোন দেশ বছরের পর বছর বিনা কিংবা ভুয়া প্রতিবাদে মেনে নেয় এমন করুণ মৃত্যু?
ভারত-পাকিস্তান নাকি ‘শত্রু’ দেশ। সেখানে বিএসএফ সীমান্ত পার হয়ে যাওয়া পাকিস্তানিদের গ্রেপ্তার করে, গুলি করে না। এই মাত্র দুই দিন আগে বিএসএফের ক্রোকোডাইল ইউনিট ভারতের জলসীমা থেকে গ্রেপ্তার করেছে পাকিস্তানি ছয় জেলেকে। গোলাগুলির ঘটনা সেখানেও ঘটে কখনো কখনো। কিন্তু পাকিস্তান-ভারত সীমান্তে অধিকাংশ সময় ঘটে গ্রেপ্তারের ঘটনা। আমরা কখনো গ্রেপ্তারের খবর পাই না, সতর্ক করে দেওয়ার জন্য ফাঁকা গুলির খবর পাই না, পাই শুধু বুকে কিংবা মাথায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর। খুন হয় মাঠে গরু চরাতে যাওয়া যুবক, বাবার আহার নিয়ে যাওয়া কিশোরী, ফসল দেখে ফিরে আসার পথে বৃদ্ধ। খুন হয় বৈরী সরকারের আমলের মানুষ, বন্ধু সরকারের আমলের মানুষ।
খুন হওয়া এই মানুষেরাও ছিল এ দেশের মানুষ। নির্বাচনে নিশ্চয়ই এরাও ভোট দিয়েছিল আওয়ামী লীগ আর বিএনপিকে। মহাশক্তিধর এই দুই দল ব্যস্ত থাকে পরস্পরকে ধ্বংস করার কাজে। সীমান্তে মানুষ খুন হলে বিএনপি ফাঁকা প্রতিবাদ করে। আওয়ামী লীগ কাকুতি-মিনতি করে। ‘বন্ধু’ রাষ্ট্রের গুলিতে মরতেই থাকে বাংলাদেশের মানুষ।
সারা পৃথিবীতে এমন বন্ধুত্বের নজির অন্য কোথাও আছে কি? আছে নজির বাংলাদেশের মতো এমন নতজানু পররাষ্ট্রনীতির?

৩.
সীমান্তে মানুষ মরলে বা সম্পদ বেহাত হলে আমরা কী করব? ভারত, আমেরিকা বা পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করব? সেটি সম্ভব নয়, সংগতও নয়। কিন্তু সম্ভব জাতিগতভাবে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদের। সম্ভব সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে নিন্দা জানানোর, প্রতিকার দাবির। যৌথ নদীতে অন্য দেশ একতরফা বাঁধ দিলে, সমুদ্রসীমায় হানা দিলে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বাগড়া দিলে আমরা কেন পারি না ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ জানাতে? জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি হলে আমাদের সংসদে কেন ওঠে না প্রতিবাদের ঢেউ? জাতীয় স্বার্থ বিপন্ন হলে আমাদের নাগরিক সমাজ কেন পারে না ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিতে?
অথচ আমাদেরই সবচেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধ থাকার কথা ছিল। আমাদের অধিকাংশ মানুষের জাতি, ভাষা ও ধর্ম এক। সংখ্যালঘু মানুষেরও নেই কোনো অসংগত দাবি। আমরাই একসঙ্গে ভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন আর স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছি। এমন বর্ণাঢ্য ইতিহাস নেই ভারত, পাকিস্তান বা পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেরই। তবু আমরা বিভক্ত এমনকি জাতীয় স্বার্থমূলক বিষয়েও।
শুধু কি সংকীর্ণ স্বার্থ বা নেতা-পূজাই রাখে আমাদের বিভক্ত করে? আমার তা মনে হয় না। এর আরেকটি কারণ আমাদের মানসিক পরাধীনতাও। আমাদের সমাজের সুবিধাভোগী মানুষের একটি বিরাট অংশকে বলা হয় ভারতের ‘দালাল’, আরেকটি বিরাট অংশকে পাকিস্তানের ‘দালাল’। এটা ঢালাও অভিযোগ, কিন্তু সকল ক্ষেত্রে ভিত্তিহীন নয়। প্রকাশ্যেই আমরা বহু হর্তাকর্তাকে দেখি নিজের দেশের কথা না বলে অন্য রাষ্ট্রের স্বার্থে কথা বলতে।
বন্ধুত্ব মানে মানসিক দাসত্ব নয়। বন্ধুত্ব মানে বিনা প্রতিবাদে কোনো অন্যায় মেনে নেওয়া নয়। বন্ধুত্ব মানে একসময়ের উপকারের কথা স্বরণ করে পরবর্তী সময়ের সকল সর্বনাশ মেনে নেওয়া নয়। আমরা অনেকেই জানি না তা। নাকি জানতে চাই না?
আমাদের পরাধীন মানসিকতা আর বিভক্তির কথা জানে প্রতিবেশী দেশ, দূরের সব দেশ। বাংলাদেশকে বিভিন্নভাবে বঞ্চিত করা সম্ভব হয় এ কারণেই।
আমাদের এই দীনতা ঘুচবে কবে?

৪.
আমার আরও কিছু বলার ছিল। সকালে উঠে প্রথম আলো পড়ে আর কিছু লেখার শক্তি হারিয়ে যায়। প্রথম আলো শেষ পাতায় ছাপিয়েছে দুই বছর নয় মাস বয়সী শিশু ধর্ষিত হওয়ার সংবাদ। মুখ চেপে এই অবোধ শিশুকে ধর্ষণ করেছে কেউ। কোনো মানুষ দেখলেই আঁতকে ওঠে এখন সে। এই লজ্জা কোথায় রাখি আমরা!
এই শিশুকে ক্ষতবিক্ষত করেছে মানুষ নামধারী এক পশু। কিংবা পশুর চেয়ে বর্বর কেউ। উন্মত্ত পশুও ধর্ষণ করে না তাদের গোত্রের বা অন্য কোনো শিশুকে। আমাদের সমাজের একজন করেছে। এই ‘মানুষ’কে খুঁজে বের করতে পারবে না পুলিশ? তাকে জামিন না দিয়ে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারবেন না কোনো আদালত?
যদি না পারে, তাহলে সেই পশুর কাছে ধর্ষিত আসলে আমরা সবাই!
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.