সংঘাতের রাজনীতি-সংলাপের জন্য আর কত অপেক্ষা? by আবু সাঈদ খান

সরকার ও বিরোধী দলের মুখপাত্ররা কেউ সংলাপের বিষয়ে দ্বিমত করছেন না। এখন প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে_ কে উদ্যোগ নেবে? সরকার বলে আসছে, বিরোধী দল সংসদে এসে প্রস্তাব দিক। বিরোধী দলের ভয়_ এমন প্রস্তাব মহাজোট সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বাতিল করে দিলে তখন কী হবে? এমন অবস্থায় সংলাপের সম্ভাবনা অনিশ্চিত।


তবে অনেকেই ভাবছেন, শেষমেশ কিছু একটা হবে। কিন্তু সেই লগ্নটা কখন, কবে? এটি যদি একেবারে সরকারের মেয়াদের শেষে গিয়ে ঠেকে, তা কি সমর্থনযোগ্য?

সবকিছু ছাপিয়ে রাজনৈতিক সংকটই এখন জনজীবনের প্রধান আলোচ্য। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও ঘনীভূত। প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো এখন সংঘর্ষ-সংঘাতে মুখোমুখি। এ বিবাদ কেবল সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, এর নির্মম শিকার হচ্ছে আমজনতাও। সাম্প্রতিক হরতালে প্রাণ হারিয়েছেন বাস শ্রমিকসহ ৫ ব্যক্তি। সংঘাতময় পরিবেশে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে সবাই। সংকট যত স্থায়ী হবে, জনজীবনে দুর্ভোগ ততই বাড়বে, শান্তি বিনষ্ট হবে, শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। উৎপাদন ও বিনিয়োগ হবে ব্যাহত। রাজনীতিকরা এটি আমাদের চেয়ে কম বোঝেন_ এমন নয়। তবে কেন এই সংকট জিইয়ে রাখা হচ্ছে?
এর উত্তর বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায়। সমস্যা হচ্ছে, ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো ক্ষমতায় যেতে চায়, সংসদে ট্রেজারি বেঞ্চে বসতে চায়; বিরোধী আসনে বসতে রাজি নয় তারা। এটি সামন্তবাদী মানসিকতাপ্রসূত। অতীতে রাজায় রাজায় যুদ্ধ হতো। কোনো রাজাই প্রতিপক্ষকে বরদাশত করতেন না। কেউ বিদ্রোহী হলে তাকে খতম করা হতো। কিন্তু গণতান্ত্রিক বিধানে বিরোধী পক্ষকে স্বীকার করতে হয়। বিরোধী দলকেও সরকারি দলের শাসন মেনে নিয়ে সংসদে বিরোধীদের আসনে বসতে হয়। এটি গণতান্ত্রিক রেওয়াজ। একে অপরকে মানতে না পারাই সংকটের অন্তর্নিহিত কারণ।
এর আগে বিএনপি ও চারদলীয় জোট সরকার গঠিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ বিরোধী আসনে বসতে চায়নি। কখনও কখনও সদস্যপদ রক্ষার জন্য সংসদে গেছে, আবার অজুহাত দেখিয়ে বেরিয়ে এসেছে। বিগত আওয়ামী লীগের শাসনকালে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছিল বিএনপি। এখনও তা-ই করছে। তবে এটি সত্য, বিরোধী দলকে কোনো ক্ষমতাসীন দল সংসদে দেখতে নারাজ। বিরোধী দলের সমালোচনা সহ্য করার জন্য যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ থাকা দরকার; সেটি তাদের নেই। সে কারণে বিরোধী দলের সাংসদরা সংসদে এলে ক্ষমতাসীন সাংসদরা হুল ফুটান; সামনের সারিতে দুটি বাড়তি আসন ছেড়ে দিতে কার্পণ্য দেখান। কিন্তু সে পরিস্থিতি মোকাবেলা করে সংসদ অধিবেশনে যোগ দেওয়ার যে মানসিকতা দরকার, তা কোনো বিরোধী দলের নেই। সদ্য সমাপ্ত সংসদ অধিবেশনে বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়া দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছেন। স্পিকার কথাও দিয়েছেন যে, বিরোধী দলের নেতার মাইক বন্ধ করা হবে না। অন্য নেতারাও কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন। টিভি চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছে সেসব বক্তব্য। তারপরও পরিবেশের দোহাই দিয়ে সংসদ বর্জন করা কি যৌক্তিক?
কোনো বিবেচনাতেই আমরা সংসদ বর্জনের রাজনীতি সমর্থন করতে পারি না। তাই বলে রাজপথে নামার অধিকার কেড়ে নেওয়া হবে, বিরোধী সাংসদদের লাঠিপেটা করা হবে_ তাও মেনে নেওয়া যায় না। রাজপথে সরকার ও বিরোধী দল শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ। বিরোধী দল হরতালের পর হরতাল দিচ্ছে, সরকার তাদের ওপর পুলিশি নির্যাতন করছে, মামলা দিয়ে বিরোধী পক্ষকে জব্দ করছে। এই যে শক্তি পরীক্ষা, তা কেবল ক্ষমতার জন্য। এখানে জনস্বার্থের কোনো ব্যাপার নেই। সরকার বিরোধী দলকে জব্দ করে ক্ষমতা নিরাপদ করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু বিরোধীদের দমনে নয়_ ক্ষমতা নিরাপদ করার সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে জনস্বার্থ সংরক্ষণ। প্রচলিত রাজনীতির প্রধান প্রবণতা দলীয় স্বার্থ, পারিবারিক, ব্যক্তি-স্বার্থকেন্দ্রিক। রাজনীতি এখন বাণিজ্য। দুই আমলেই দেখেছি, রাজনীতিকে পুঁজি করে নেতাদের একাংশ কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার মালিক হয়েছেন, হচ্ছেন। নেতাদের মন সংসদে নয়, নিজ নিজ ব্যবসা কিংবা তদবিরবাজিতে। যে কারণে সংসদে কোরাম সংকট হচ্ছে। অর্থ উপার্জনের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন কর্মীরাও। তারা লিপ্ত দখলবাজি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিতে। রাজনীতিতে আদর্শবাদের স্থলে ভোগবাদ রাজত্ব করছে। দিন দিন কালো টাকা ও পেশির দাপট বাড়ছে; মেধাবী ও ত্যাগী নেতাকর্মীরা হচ্ছেন বিতাড়িত। এটি এখন রাজনৈতিক অঙ্গনের চিত্র।
আমরা বিরোধী দলের সাড়ে তিন বছরের আন্দোলন যদি পর্যবেক্ষণ করি তাহলে দেখা যাবে, তা মূলত দলীয় স্বার্থে পরিচালিত। শুরুর দিকে ইস্যু ছিল দলীয় নেতাদের দুর্নীতির মামলা প্রত্যাহার, খালেদা জিয়ার বাড়ি রক্ষা, নেতাদের ওপর নির্যাতন বন্ধ ইত্যাদি। আমি মনে করি, নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন, বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর গুম নিয়ে যে আন্দোলন, তা অবশ্যই যৌক্তিক। তবে তার আগে গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামসহ শতাধিক গুমের ঘটনা ঘটেছে। ঢাকার আশপাশে যখন ক্ষত-বিক্ষত লাশ ও কঙ্কাল পাওয়া গেছে; এসব ঘটনায় আন্দোলনের তাগিদ বোধ করেনি বিরোধী দল। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ-গ্যাস সংকট, শেয়ার কেলেঙ্কারি, দুর্নীতি_ এর কোনোটি নিয়ে কি বিএনপি পথে নেমেছে? তাই এ প্রশ্ন সঙ্গত যে_ বিএনপি কি কেবল দলীয় স্বার্থে রাজনীতি করে? জনগণের প্রতি কি তাদের কোনো দায় নেই?
এ কথা অস্বীকার করার জো নেই যে, বিরোধী আন্দোলনে জনগণের কোনো অংশগ্রহণ নেই। আন্দোলনে সেসব কর্মীই আগ্রহী_ যাদের হাত থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য, ঠিকাদারি, থানা-রেজিস্ট্রি অফিসের দালালির ক্ষমতা হাতছাড়া হয়েছে। তারা আন্দোলন করছে সেই হারানো ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার জন্য, জনসেবার মনোভাব থেকে নয়।
সঙ্গত কারণেই বিরোধী দলের আন্দোলন থেকে জনগণ মুখ ঘুরিয়ে রেখেছিল। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে সরকার বিরোধী দলের হাতে একটি ইস্যু ধরিয়ে দিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল আওয়ামী লীগসহ সে সময়ের অন্যান্য বিরোধী দলের আন্দোলনের ফসল। আওয়ামী লীগ এ বিধানকে ব্রেনচাইল্ড বলেও আত্মগরিমা দেখিয়েছে। আদালতের রায়কে অজুহাত হিসেবে দেখিয়ে বিধানটি বাতিল করেছে। আওয়ামী লীগ বলছে, তারা আদালতের রায়ের ভিত্তিতে এ বিধান বাতিল করেছে। কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে, আদালতের রায়ে আরও দুই মেয়াদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান রাখা যেতে পারে_ এমন পর্যবেক্ষণ ছিল। আদালতের কাছে বিবেচ্য ছিল রাজনৈতিক বাস্তবতা। কিন্তু ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার তা বিবেচনায় না নেওয়ায় রাজনৈতিক সংকটের জন্ম হয়েছে। বিরোধী দলের কাছে এখন এটি প্রধান ইস্যু। সঙ্গত কারণে এ প্রশ্নে জনসমর্থন রয়েছে। এমনকি আওয়ামী লীগ ছাড়া মহাজোটের শরিক দলগুলোও মনে করে, একটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা দরকার। তা না হলে বিএনপিকে বাইরে রেখেই নির্বাচন করতে হবে। এমন নির্বাচন হলে তা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।
এখানে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। দল দুটির ভোট ব্যাংক সমান বলা যায়। গত নির্বাচনগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, বিএনপির শাসনে বীতশ্রদ্ধ, ক্ষুব্ধ জনতা আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন দিয়েছে। আবার আওয়ামী লীগের শাসনে বীতশ্রদ্ধ, ক্ষুব্ধ জনগোষ্ঠী বিএনপির দিকে ঝুঁকেছে। এ কারণে ক্ষমতা বদল হয়েছে। তবে বাস্তব সত্য হচ্ছে, দুই দলের প্রতি ক্ষুব্ধ নর-নারীর সংখ্যাই সর্বাধিক। কিন্তু তৃতীয় কোনো দল বা জোট দৃশ্যমান না থাকায় জনগণকে দুই ভাগে ভোট দিতে হচ্ছে। এ কারণে জনগণ আজ দ্বিদলীয় ব্যবস্থার কাছে জিম্মি। আমার মনে হয়, যদি 'না' ভোটের বিধান থাকত, তবে নির্বাচনে না ভোটই জয়যুক্ত হতো। সেটি প্রবর্তন করাও আজ প্রয়োজন।
সে যা-ই হোক, সরকারের একচোখা ও ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক সংকটকে ঘনীভূত করেছে, করছে। এটি দমন-পীড়ন, হামলা-মামলা দিয়ে মোকাবেলা করার অবকাশ নেই। এর সমাধান হতে হবে আলোচনার টেবিলে। আর তা না হলে সংকট বাড়বে। লাভবান হবে নেপথ্যের শক্তি, যা কারও কাম্য হতে পারে না। তাই গণতন্ত্রের অভিযাত্রা অব্যাহত রাখতে হলে সরকার ও বিরোধী দলকে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের পদ্ধতি নিয়ে ঐকমত্যে আসতে হবে। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর এক টেবিলে বসা দরকার।
সরকার ও বিরোধী দলের মুখপাত্ররা কেউ সংলাপের বিষয়ে দ্বিমত করছেন না। এখন প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে_ কে উদ্যোগ নেবে? সরকার বলে আসছে, বিরোধী দল সংসদে এসে প্রস্তাব দিক। বিরোধী দলের ভয়_ এমন প্রস্তাব মহাজোট সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বাতিল করে দিলে তখন কী হবে? এমন অবস্থায় সংলাপের সম্ভাবনা অনিশ্চিত। তবে অনেকেই ভাবছেন, শেষমেশ কিছু একটা হবে। কিন্তু সেই লগ্নটা কখন, কবে? এটি যদি একেবারে সরকারের মেয়াদের শেষে গিয়ে ঠেকে, তা কি সমর্থনযোগ্য?
এ সংকট নিরসন না হলে, সংঘাতের রাজনীতি অব্যাহত থাকলে কেবল জনদুর্ভোগ বাড়বে না, উৎপাদন ও বিনিয়োগই ব্যাহত হবে না_ রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতিরও জন্ম নেবে। গণতন্ত্রের শিশুটি রক্তাক্ত হবে, রাজনৈতিক মঞ্চে ষড়যন্ত্রকারী শক্তির আবির্ভাব ঘটবে_ গণতন্ত্রের দাবিদাররা কেন এটি বুঝতে চাইছেন না! তবে কি নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ করার পরশ্রীকাতর মানসিকতায় ভুগছেন তারা? আজ যতটুকু গণতন্ত্র আছে_ তা ব্যাহত হলে সরকার ও বিরোধী দল কারও জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না। ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ ও জনগণ। জানি না, গণতন্ত্র বিধ্বংসী এই খেলা কতকাল চলবে, দেশ আর কতকাল রক্তাক্ত হতে থাকবে?

আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
 

No comments

Powered by Blogger.