পরিবেশ-বন ও প্রকৃতিই দিতে পারে শান্তির নীড় by মোঃ খবির উদ্দীন

বন ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কিছু বিষয় অধিক জোরালো করা প্রয়োজন। যে পরিমাণ বনভূমি বিদ্যমান তা অবশ্যই সংরক্ষণ করতে হবে। সামাজিক বনায়নে দেশজ প্রজাতির গাছ রোপণ, সংরক্ষণ ও প্রাকৃতিক আবাসস্থল সংরক্ষণ করতে হবে
আদিম সভ্যতার উর্বর ভিত্তির ওপর গড়ে উঠেছে আজকের এই আধুনিক সভ্যতার মহীরুহ।


একবিংশ শতাব্দীর উষালগ্নে সভ্যতার স্বর্ণশিখরে মানবজাতি ধীরে ধীরে ধ্বংস করেছে বনাঞ্চল। শিল্প বিপ্লব এবং এর পরবর্তী নগরায়ন প্রক্রিয়ার যান্ত্রিকতা ধরিত্রীর সবুজ রঙটিকে বদলে ধূসর করে দিয়েছে।
গতকাল ছিল বিশ্ব পরিবেশ দিবস। এবারের মূল প্রতিপাদ্য ছিল বন : প্রকৃতি আপনার সেবা করে। মানুষের সঙ্গে বন ও প্রকৃতির আদি ও অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক।
বেঁচে থাকার প্রয়োজনে মানুষ বিনষ্ট করে পরিবেশ ও প্রকৃতিকে। এভাবে সমস্যা বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে পেঁৗছায় যে তখন সমস্যা গ্রাস করে নেয় সমস্ত রাষ্ট্রকে। এমন একটি উদাহরণ আমাদের এই প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশ। ১৯৯২ সালে রিও ঘোষণায় বন সৃজন ও রক্ষার্থে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরও সারা পৃথিবীতে উজাড় হয়েছে ২০টি বাংলাদেশের সমান আয়তনের বনভূমি। পৃথিবীতে আয়তনে অতি ছোট এই বাংলাদেশ কিন্তু জনসংখ্যার বিচারে বিশাল। প্রয়োজনের তুলনায় নূ্যনতম আকারের এই বনভূমিও বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্বৃত্তপনায় আজ ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন।
বনভূমি পরিবেশ সংরক্ষণের মুখ্য হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে। আমাদের পরিবেশকে আমাদেরই বাঁচাতে হবে। পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় একটি দেশের মোট আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন কিন্তু বাংলাদেশে এর পরিমাণ শতকরা মাত্র ৭.৭ ভাগ। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে অস্ত্রোপচারের পর যেসব রোগী গাছের দৃশ্য উপভোগ করতে পেরেছে তারা বেশ দ্রুত আরোগ্য লাভ করেছে। গাছের ছায়া গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা হ্রাস করে বাড়িঘরের পরিবেশ শীতল রাখে। শিকড় থেকে যে পানি গাছের উপরাংশে উঠে আসে তা বাষ্পে পরিণত হয়ে পারিপাশর্ে্বর অনেক তাপ শুষে নেয়। যখন পানির প্রাপ্তি ও তাপমাত্রা বেশি থাকে তখন একটি বড় গাছ একদিনে ৪০০ গ্যালন পানি বাষ্পে পরিণত করতে পারে। এর ফলে শহরাঞ্চলে ঘরবাড়ি, অফিস, আদালত, শিল্পকারখানা ঠাণ্ডা রাখার জন্য বিদ্যুৎ খরচের অনেকখানি সাশ্রয় হতে পারে।
এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণে কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন করে এবং পর্যাপ্ত অক্সিজেনের জোগান দেয়। পৃথিবীর মিঠাপানির এক-তৃতীয়াংশ আসে বন উপকূল থেকে। আমরা কাঠ, জ্বালানি, রাবার, কাগজ এবং ঔষধি গাছও পাই বন থেকেই। জীববৈচিত্র্য রক্ষায়ও গাছপালার ভূমিকা অপরিসীম। মানুষের জীবনযাত্রা মানসম্মত রাখতে এবং একটা দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বনকে সম্পদে পরিণত করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেও আমাদের দেশের ওপর প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব বেশি। আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে খুব সহজে রক্ষা করতে পারে বনাঞ্চল। সিডরের গতি বাধাগ্রস্ত করেছিল আমাদের ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন, যার ফলে মানবজীবনের ক্ষতি যে পরিমাণ হতে পারত তার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অথবা এর কম হয়েছে। বায়ুমণ্ডলীয় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এ তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পরিবেশের বিভিন্ন রকম বিপর্যয়ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ তথা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য একমাত্র সহজ পথ হচ্ছে দেশে বৃক্ষায়ন এবং পরিচর্যার মাধ্যমে গাছগুলো দ্রুত বর্ধনের মাধ্যমে বনাঞ্চল বৃদ্ধি করে পরিবর্তনগত পরিবর্তনের ফলে দুর্যোগ লাঘব করা। গাছের উপকারিতার কথা লিখে শেষ করা যাবে না। এক কথায় গাছ না থাকলে অন্য জীবকুলের জীবন চিন্তা করা যায় না।
বনাঞ্চল পর্যায়ক্রমে কমার ফলে আমাদের দেশে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। যেমন_ সিডর, আইলা, অতিগরম, অনাবৃষ্টি ইত্যাদি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, মাটি ক্ষয়, অনুর্বরতা, জীবকুলের আবাসস্থল তথা জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট হচ্ছে বনাঞ্চল কমার মাধ্যমে।
সবুজায়নে জনগণকে উদ্বুদ্ধকরণে বনায়ন সম্প্রসারণ কার্যক্রমকে একটি সামাজিক আন্দোলনে রূপদানের লক্ষ্যে চলতি বছর ১০ কোটি চারাগাছ উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। উৎপাদিত চারাগাছ থেকে প্রত্যেক সাংসদকে ২৫ হাজার করে দেওয়া হবে। এ গাছের কিছু অংশ পরিবেশ রক্ষার্থে যারা কাজ করছে তাদেরও হাতে যাওয়া প্রয়োজন। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বৃক্ষায়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রত্যেক বছরই বৃক্ষায়ন করা হয় আনুষ্ঠানিকভাবে কিন্তু পর্যাপ্ত পরিচর্যার অভাবে পরবর্তী বছরে আর সে জায়গায় গাছ দেখা যায় না। সে কারণে বৃক্ষ রোপণের আনুষ্ঠানিকতা করতে জায়গার অভাব হয় না। আমাদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে আমি যতটি গাছ রোপণ করব ঠিক ততটিকে টিকিয়ে রাখব।
উন্নয়নের উপজাত গ্রিনহাউস গ্যাস, বিশেষত কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ কমিয়ে আনতে বনায়নের ভূমিকা যে আবশ্যক সে উদ্যোগটিকে বিশ্বব্যাপী প্রচার করতে জাতিসংঘ বন বর্ষ পরিকল্পনা করেছে। ২০১১ সালকে জাতিসংঘ কর্তৃক আন্তর্জাতিক বন বর্ষ ঘোষণা করা হয়েছে। বনভূমি সংরক্ষণের গুরুত্ব অনুধাবনে সবাইকে সচেতন করার উদ্দেশ্যেই এ বছরটিকে বন বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
বন ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কিছু বিষয় অধিক জোরালো করা প্রয়োজন। যে পরিমাণ বনভূমি বিদ্যমান তা অবশ্যই সংরক্ষণ করতে হবে। সামাজিক বনায়নে দেশজ প্রজাতির গাছ রোপণ, সংরক্ষণ ও প্রাকৃতিক আবাসস্থল সংরক্ষণ করতে হবে। প্রয়োজন ব্যাপকভিত্তিক প্রাকৃতিক বনায়ন কার্যক্রমকে উৎসাহিত করা ও দেশজ অধিক পাতাযুক্ত লতানো প্রজাতির গাছপালা রোপণ কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধকরণ এবং সরকারি নীতিমালা প্রণয়নপূর্বক সারাদেশে বৃক্ষরোপণ কার্যক্রমে বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা। সেক্ষেত্রে বন উজাড় বা নিধনে কোনো ধরনের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। বনায়ন কার্যক্রমে বেসরকারি সংস্থা ও উদ্যোক্তাদের সরকারিভাবে সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে। আরও প্রকল্পের মাধ্যমে প্রাকৃতিক জলাধারকেন্দ্রিক বন সংরক্ষণ, নতুনভাবে বন সৃষ্টি করা, প্যারাবন ও ইকোপার্ক স্থাপনের বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া; বন উজাড় ও বন নিধনকারীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা; পরিকল্পিত নগরায়নে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া ও সবুজ নগরায়ন কার্যক্রমের প্রচলন পরিকল্পনায় নিয়ে আসা আবশ্যক। বিদ্যমান শিল্পকারখানায় বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা বা ইটিপি স্থাপন অত্যাবশ্যক করা উচিত। এ শিল্পবর্জ্য গাছপালা তথা বাংলাদেশের পরিবেশের জন্য অন্যতম প্রধান হুমকিস্বরূপ। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে পতিত জমি, মহাসড়ক ও নদ-নদীর তীরে উপযোগী বৃক্ষ রোপণ করা। এমনকি প্রত্যেক নাগরিককে শহরের ক্ষেত্রে বাড়ির ছাদে ও টবে গাছ রোপণে উদ্বুদ্ধকরণ ও গণসচেতনতা সৃষ্টি করা আবশ্যক। অর্থাৎ সবুজ জীবনযাপনে অভ্যাস গড়ে তোলা।
নবায়নযোগ্য বাণিজ্যিক বনায়ন : এই ধারণাটি অনেকটাই নতুন। নবায়নযোগ্য শক্তির মতো এই বনাঞ্চলও ব্যবহার করা যাবে বারবার। ধারণাটি অনেকটা এমন, যদি ৩৬৫ একর জমি নেওয়া হয় আর তার প্রথম ১ একরে দ্রুত বর্ধনশীল পরিবেশবান্ধব এক হাজার গাছ লাগানো হয় আর এভাবে ৩৬৫ দিনের একেক দিন এক একর করে জমিতে গাছ লাগানো হয়। এতে করে ৩৬৫ দিনের প্রথম দিন যে এক হাজার গাছ লাগানো হয়েছিল তা শেষ দিন যে গাছ লাগানো হবে সেদিন কাটার উপযুক্ত হয়ে যাবে। তা কাটা হয়ে গেলে ওখানে আবার নতুন করে গাছ লাগানো হবে। এভাবে এক পাশে গাছ কাটার উপযুক্ত হবে আবার সঙ্গে সঙ্গে অন্য পাশে গাছ লাগানো হবে। এতে করে সারাবছরই আমরা গাছ কাটতে পারব নিজেদের প্রয়োজনে আর সেই সঙ্গে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হবে।
আমাদের দেশকে রবিঠাকুরের ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়ে পরিণত করতে হলে বনাঞ্চলকে ৭.৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে কমপক্ষে ২৫ শতাংশে যত শিগগির পরিণত করতে হবে। আসুুন আমরা বেশি বেশি গাছ লাগাই, গাছের সেবা পেতে থাকি এবং পরিবেশ রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হই।

ড. মোঃ খবির উদ্দীন : অধ্যাপক পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ, জাবি ও সভাপতি বাংলাদেশ পরিবেশবিজ্ঞানী সমিতি
 

No comments

Powered by Blogger.