ধর্ম-জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় ইসলামের নির্দেশনা by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি অধিক গুরুত্ব পেয়েছে। স্বাস্থ্যই সম্পদ। সুস্থতাই সফলতা। আর সবল ও সুস্থতা ইসলামের কাম্য। যেহেতু আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি মানুষের প্রধানতম কাজ, সেহেতু তার সুস্থ থাকা অতীব প্রয়োজনীয়।


কারণ, অসুস্থ দেহ-মন নিয়ে বিধিবদ্ধ ইবাদত যথাযথভাবে আদায় করা হয় না, বিধায় এগুলো গ্রহণযোগ্য হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। তাই ইসলাম জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেছে। শারীরিক শিক্ষা বা ব্যায়াম দেহের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের সন্তানদের সাঁতার এবং তিরন্দাজি শেখাও।’
মানুষের স্বাস্থ্যের শারীরিক ও মানসিক দুটি দিক রয়েছে। উভয় দিকের পরিপূর্ণ প্রতিরোধ-প্রতিরক্ষার সুব্যবস্থা করেছে ইসলাম। সুস্থ ও সবল থাকাকে অনুপ্রাণিত করতে ইসলাম ঘোষণা করেছে, ‘শক্তিশালী, সুস্থ মুমিন দুর্বল মুমিনের চেয়ে উত্তম।’
ইবাদতের ক্ষেত্রে সুস্বাস্থ্যের ভূমিকা অপরিসীম। আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি করার জন্য যথেষ্ট শারীরিক শক্তি প্রয়োজন। দৈহিক শক্তি আল্লাহর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিয়ামত। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সত্তা সব শক্তির আধার। তাঁর শক্তি অসীম ও অতুলনীয়। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী মহান প্রভুর নিপুণ সৃষ্টিরাজিতেও শক্তির সঞ্চার করা হয়েছে। তাঁর বাণীবাহক ফেরেশতা হজরত জিবরাইল (আ.)-এর শক্তির প্রশংসা তিনি নিজেই করেছেন। যে সর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্বনবী (সা.)-এর ওপর তাঁর পবিত্র কালাম অবতীর্ণ হয়েছে, তাঁকেও দান করেছিলেন বিশাল শক্তি, যার দ্বারা আল্লাহ পাক তাঁর অন্যতম সিফাত শক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। এ সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ঈমানদার ব্যক্তির শারীরিক শক্তি আছে, তিনি শ্রেষ্ঠ ও আল্লাহর কাছে প্রিয় সে মুমিন অপেক্ষায় যে দুর্বল, শক্তিহীন, যার শারীরিক শক্তি কম।’
মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশে স্বাস্থ্যের জুড়ি নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) পাঁচটি অমূল্য সম্পদ হারানোর আগে এগুলোর কদর করার কথা বলেছেন। এর অন্যতম হচ্ছে স্বাস্থ্য ও সুস্থতা। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, নবী করিম (সা.) সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘পাঁচটি বিষয়কে অপর পাঁচটি বিষয়ের আগে গনিমত মনে করো। অর্থাৎ পাঁচটি বিষয়কে বিপরীত পাঁচটি বিষয়ের আগমনের আগে সংরক্ষণ করো বা কাজে লাগাও। ১. বার্ধক্যের আগে তোমার তারুণ্যকে, ২. দরিদ্রতার আগে তোমার সচ্ছলতাকে, ৩. অসুস্থতার আগে তোমার সুস্থতাকে, ৪. ব্যস্ততার আগে তোমার অবসর সময়কে এবং ৫. মৃত্যুর আগে তোমার জীবনকে।’
জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা করার জন্য শরিয়তে এমনভাবে তাগিদ দেওয়া হয়েছে যে এটাকে যথেচ্ছ ব্যবহার করা যাবে না। ইসলামি বিধানের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা করা। একজন সাহাবি দিনভর রোজা রাখতেন আর রাতভর নামাজ পড়তেন। নবী করিম (সা.) তাঁকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন, ‘নিশ্চয়ই তোমার ওপর তোমার শরীরের হক আছে।’ পক্ষান্তরে রোগ-ব্যাধি হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হলো মানুষের অলসতা ও কর্মবিমুখতা। বিভিন্ন রোগের উৎস মূলত আলস্য ও কর্মবিমুখতা। তাই রাসুলুল্লাহ (সা.) দোয়া শিখিয়েছেন, ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে অলসতা থেকে পানাহ চাই।’
মানবদেহে যেসব কারণে নানা রোগ বাসা বাঁধে এগুলোর মধ্যে অপরিণামদর্শী খাদ্যাভ্যাস এবং অতিভোজন অন্যতম, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তাই ইসলাম মাহে রমজানের এক মাস সিয়াম সাধনাকে ফরজ করে দিয়েছেন। এ ছাড়া অন্যান্য সময়ে রোজা রাখাকে উৎসাহিত করেছে। আর পরিমিত আহার গ্রহণের বিষয়ে ইসলাম যথার্থ তথা স্বাস্থ্য-উপযোগী পথ নির্দেশ করেছে। অধিক খাদ্য গ্রহণ বেশি রোগের কারণ। পেটকে সব রোগের কেন্দ্রস্থল হিসেবে হাদিসে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে পেটের এক-তৃতীয়াংশ খাদ্য গ্রহণ, এক-তৃতীয়াংশ পানি পান এবং অন্য অংশ খালি রাখাই হলো নিরাপদ খাদ্যাভ্যাস। তাই রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা অধিক ভোজন থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাও।’ (বুখারি)
ইসলাম কখনো উদরপূর্তি করে খাদ্য গ্রহণে উৎসাহিত করে না। ইসলামের দিকনির্দেশনা হচ্ছে, যখন ক্ষুধা পাবে কেবল তখনই পানাহার করবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আমরা এমন একটি সম্প্রদায়, যারা খাওয়ার প্রয়োজন ব্যতীত খাদ্য গ্রহণ করি না। আর যখনই আমরা খাদ্য গ্রহণ করি তৃপ্তির সঙ্গে (উদরপূর্তি করে) ভক্ষণ করি না।’ প্রয়োজনাতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ না করার ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে, ‘তোমরা খাও এবং পান করো, তবে অপব্যয় কোরো না।’ (সূরা আল-আরাফ, আয়াত-৩১) অপব্যয় বলতে খাদ্য-পানীয় নষ্ট না করা এবং প্রয়োজনাতিরিক্ত গ্রহণ না করা।
ইসলামে পানাহার করার একটি স্বাস্থ্যসম্মত নীতি রয়েছে। যে নীতিমালা লঙ্ঘিত হলে সে আহারই শরীরের ক্ষয় পূরণের পরিবর্তে এতে বরং ঘাটতি এনে দেবে। শরীরে জন্ম নেবে নানা রোগের উপকরণ। এ জন্য রাসুলে করিম (সা.) নিষেধ বাণী প্রদান করেছেন, ‘তোমরা উদরপূর্তি করে ভোজন কোরো না, কেননা এতে তোমাদের অন্তরে আল্লাহর ভয় নিষ্প্রভ হয়ে যাবে।’ (বুখারি) অন্য হাদিসে বর্ণিত আছে যে ‘অধিক আহার দুর্ভাগ্যজনক।’ (বায়হাকি)
পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহ এবং ইসলামি শরিয়ত জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য যেমন গুরুত্ব দিয়েছে তেমনি তা কার্যকরের ফলপ্রসূ উপায় বাতলে দিয়েছে। যেমন—নেশাজাতীয় দ্রব্য হারাম করা, পরিমিত আহার, সময়ানুগ খাবার গ্রহণ ইত্যাদি। স্বাস্থ্য সুরক্ষার পরপরই ইসলাম রোগ প্রতিরোধের প্রতি জোরালো তাগিদ দিয়েছে এবং রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে উৎসাহিত করেছে। যে জিনিসগুলোর কারণে মানুষের রোগ-ব্যাধি হয় ইসলাম আগেই সেগুলোকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশের প্রতি ইসলাম বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। রোগ-ব্যাধি ছড়ানোর বড় কারণ হচ্ছে অপরিষ্কার ও নোংরা পরিবেশ। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ।’ পরিবেশের ভারসাম্যতা নষ্ট হতে পারে এমন কোনো কার্যক্রমই ইসলামে স্বীকৃত নয়। এ জন্য ইসলামসম্মত পরিবেশ গড়ে তুলতে পারলে রোগ-বালাই থেকে রক্ষা পাওয়া সহজতর হয়। ইসলাম মানবতার কল্যাণের জন্য যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন তার সবটুকুই করেছে। অসুস্থ ব্যক্তির সঙ্গে উত্তম আচরণ এবং তার চিকিৎসার জন্য সুস্থ ব্যক্তিকে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। ইসলামের এই নির্দেশনা মোতাবেক চললে ইহকালীন ও পারলৌকিক সফলতা অবশ্যম্ভাবী। ইসলামের স্বাস্থ্যনীতি অনুসরণ করা মুসলমান হিসেবে প্রত্যেকের জন্য অত্যাবশ্যক।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান, সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমি (ইনস্টিটিউট অব ইন্টেলেকচুয়াল স্টাডিজ), দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.