জন্ম যদি তব পানিধারে by রাধাকান্ত রায়

লেখাটিতে যে ছবিটি রয়েছে তিনি বড়লেখার এক নায়ক। এক সময়ের সিলেট জেলার অন্তর্ভুক্ত করিমগঞ্জ মহকুমার বড়লেখা থানা পাকিস্তানের গণভোটের সময় মৌলভীবাজার জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়। তখন বড়লেখার জমিদার রামকুমার পুরকায়স্থের কথা ছিল, যেহেতু সমগ্র সিলেট জেলাই এককালে বাংলাদেশেই ছিল, তাই বড়লেখা সিলেটেই থাকুক।


তার এই তাত্তি্বক কথাটা তখন কিছু হিন্দুর মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ায়, কিন্তু কাজে আসেনি।
রামকুমার পুরকায়স্থের কর্মযজ্ঞ আমাকে সবসময়ই ভাবায়। অবাক বিস্ময়ে শুধু ভাবি, আত্মীয় জগতের পরশ্রীকাতর প্রতিকূলে পড়েও তিনি যে কীভাবে হতদরিদ্র লোকদের জন্য এক সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি রেখে কাজ করে গেছেন তাদেরই অজান্তে আজি হতে শতবর্ষ পূর্বে বড়লেখা থানার পানিধার গ্রামে। তার কর্মযজ্ঞের সঙ্গে গ্রামের সবার সহায়তার হাত প্রসারিত না থাকলেও সমগ্র থানায় তা সংকুচিত ছিল না। তার এক অতি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দৃষ্টি ছিল বলেই তিনি পূর্ব পানিধারের তিনটি রাস্তা ১৫ ফুট প্রশস্ত রেখে কাঁঠালতলী মৌজায় অন্তর্ভুক্ত করে গিয়েছিলেন। সেগুলো পশ্চিমে সিঅ্যান্ডবি রাস্তা থেকে পূর্বে ছাতনিছড়া পর্যন্ত প্রলম্বিত ছিল।
তার বাড়ির জায়গার পরিমাণ তিন একর। দেখতে আয়তক্ষেত্র। বাড়ির দু'পাশে দুটি ১৫ ফুট প্রশস্ত সমান্তরাল রাস্তা। অন্যটিও ১৫ ফুট প্রশস্ত, একটু দূরে। তিনটি রাস্তাই সিঅ্যান্ডবি থেকে ছাতনিছড়ায় লেগেছে। তিনি তার বাড়ির পাশে যেমন ১৫ ফুট রাস্তা রেখেছেন, ঠিক তেমনি সমানভাবে রেখেছেন তার প্রজাদের বাড়ির পাশে। এই যে সাম্য চিন্তা সেটা নজর কেড়েছিল আজকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের প্রফেসর ড. রঙ্গলাল সেনের। তিনি চুয়ান্ন সালের দিকে কাঁঠালতলী পাঠশালায় প্রধান শিক্ষক থাকাকালে বর্ষার জলে ভরা ছড়ার পাড়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে বলতেন, রামকুমার বাবুর সাম্য দৃষ্টির আড়ালে নগর চিন্তার এক স্বপ্ন আছে নিশ্চয়, নয়তো কেন এমন সমান্তরাল প্রশস্ত রাস্তা করে গেছেন ৫০ বছর আগে। লোকে রাস্তা পায় না, আর আজ সেই করে যাওয়া রাস্তা হতভাগ্য লোকগুলো দখল করে রেখেছে। রঙ্গলাল বাবু আগে যেমন সাম্যবাদী ছিলেন, এখনও সেই চিন্তার ধারক ও বাহক। রাস্তাগুলোর এই করুণ দশার কথা শুনে তিনি আক্ষেপ করেন।
রামকুমার পুরকায়স্থের বাড়ির সামনের পুকুরটিতে সাবান দিয়ে কাপড় ধুলে জল নষ্ট হবে বললে সবাই ভুল বুঝত। এধরনের চিন্তার ফলে যে পরিবেশ দূষণ হয়, অন্যের জিনিসের দিকে লোভ জন্মায়, তাতে সমাজ ব্যবস্থায় সন্ত্রাস ছড়ায়, তা কি ভেবে দেখার জন্য শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে না? অবশ্য শিক্ষিত হলেই যে এসবের ঊধর্ে্ব ওঠা যাবে, তাও নয়। তবে যে কোনো মূল্যে যথাস্থানে রাস্তা দুটি হতেই হবে। অবৈধ দখলমুক্ত করতেই হবে।
রামকুমার পুরকায়স্থকে নিয়ে অনেক লেখা অনেক পত্রিকায় রয়েছে। কিন্তু তার পত্নী মোক্ষদাসুন্দরীকে নিয়ে লেখা নেই। রামকুমার বাবুর বাড়ির দক্ষিণে যে রাস্তাটি সিঅ্যান্ডবি থেকে ছাতনিছড়ায় গিয়ে লেগেছে, সেটা এককালে জনগণের চলার পথ ছিল। প্রশস্ত ছিল ১৫ ফুট। নাম ছিল মোক্ষদাসুন্দরী সড়ক। সম্পূর্ণ রাস্তাটি রামকুমার পুরকায়স্থের বাড়ির দাগের। মোক্ষদাসুন্দরী বাবার একমাত্র মেয়ে হওয়ায় তার জমিদারিটাও রামকুমার পুরকায়স্থ পান। প্রজাহিতৈষী এই নারীকে কোনো অবস্থাতেই ভোলা যায় না। রাস্তাটি তার নামেই উৎসর্গ করা দরকার। বাড়ির উত্তর দিকের রাস্তাটি যেহেতু পর্চায় রামকুমার পুরকায়স্থ সড়ক হিসেবে রয়েছে, তাই দক্ষিণেরটি মোক্ষদাসুন্দরী সড়ক করে দিলে দু'জনের দুটি পথ দুটি দিকে বেঁকে গেলেও জনগণের মনে চিরদিন বেঁচে থাকবেন। দালানকোঠা এগুলো চিরদিন থাকবে না। থাকবে না জায়গা-জমিও_ থাকবে শুধু রাস্তা দুটি। পথিকের পায়ের ধুলা অঙ্গে মেখে ধন্য হবে নাম দুটি।
 

No comments

Powered by Blogger.