বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৩৩০ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। শহীদ ফারুক আহমদ পাটোয়ারী, বীর প্রতীক অতর্কিত হামলায় শহীদ হলেন তিনি পালিয়ে যাওয়া একদল পাকিস্তানি সেনাকে দেখতে পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের নিঃশব্দে ঘিরে ফেললেন।


মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমদ পাটোয়ারী, অলিউল্লাহ পাটোয়ারী, এরশাদ উল্লা, আবদুল মতিন পাটোয়ারী প্রমুখ। ফারুক আহমদ পাটোয়ারীর কাছে এলএমজি। সবার আগে গর্জে উঠল তাঁর অস্ত্র। পাকিস্তানি সেনাদের দিক থেকে কোনো প্রত্যুত্তর এল না। মুক্তিযোদ্ধারা গুলি ছোড়া বন্ধ করলেন। তারপর কেটে গেল কয়েক মিনিট। চারদিক নিস্তব্ধ। কোনো শব্দ নেই। ফারুক আহমদ পাটোয়ারী ভাবলেন পাকিস্তানি সেনারা সব শেষ। এলএমজি কাঁধে নিয়ে তিনি যেই উঠে দাঁড়িয়েছেন, অমনি তাঁর দিকে ছুটে এল একঝাঁক গুলি। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। এ ঘটনা শাশিয়ালীতে। ১৯৭১ সালের ২৯ জুলাই।
শাশিয়ালী চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার অন্তর্গত। ২৯ জুলাই একদল মুক্তিযোদ্ধা (দুই প্লাটুন) অবস্থান করছিলেন শাশিয়ালীর হাজীবাড়িতে। দুপুর আনুমানিক ১২টা। এমন সময় কয়েকজন গ্রামবাসী তাঁদের খবর দেন, ১৫-১৬টি নৌকা করে পাকিস্তানি সেনারা শাশিয়ালীর দিকে আসছে। তাদের সঙ্গে আছে পুলিশ ও রাজাকার।
কিছুক্ষণ পর গ্রামবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের আবার জানান, পাকিস্তানি সেনাদের আরেকটি দল কড়ইতলীর ভেতর দিয়ে হেঁটে আসছে। মুক্তিযোদ্ধারা খবর পেয়ে দ্রুত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পাকিস্তানি সেনাদের মোকাবিলার প্রস্তুতি নিলেন। নৌকা মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের নাগালের মধ্যে আসামাত্র একযোগে গর্জে ওঠে সবার অস্ত্র। চার-পাঁচজন পাকিস্তানি সেনা এবং সাত-আটজন রাজাকার ও পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে নিহত হয়। চার-পাঁচটি নৌকা পানিতে ডুবে যায়।
সেখানে শুকনো জায়গা তেমন ছিল না। ফলে পাকিস্তানি সেনারা পাল্টা আক্রমণ চালাতে ব্যর্থ হয়। একপর্যায়ে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন স্থানে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ চলতে থাকে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ছয়-সাতজনের একটি দল আশ্রয় নেয় এক আখখেতে। ফারুক আহমদ পাটোয়ারীসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা তাদের দেখতে পেয়ে ঘেরাও করেন। ওই সময় সেনাদের তিন-চারজন একটি মাচানে বসে এবং বাকিরা খেতের আইলের আড়ালে পজিশনে ছিল। ফারুক আহমদ পাটোয়ারী তাঁর এলএমজি দিয়ে প্রথম গুলি শুরু করেন। সে কয়জন মাচানে বসে ছিল, তারা এলএমজির গুলিতে সঙ্গে সঙ্গে নিহত হয়। খেতের আইলে যারা ছিল তারা বেঁচে যায়। তারা পাল্টা গুলি না ছুড়ে চুপচাপ থাকে।
তারপর নিঃশব্দে কাটে কয়েক মিনিট। ফারুক আহমদ পাটোয়ারী মনে করেছিলেন সব পাকিস্তানি সেনা নিহত। তিনি উঠে দাঁড়ানোমাত্র বেঁচে যাওয়া পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি করে। তখন তিনি আহত হন। সহযোদ্ধারা তাঁকে দ্রুত উদ্ধার করে পাঠালেন চিকিৎসকের কাছে। চিকিৎসকের যথাসাধ্য প্রচেষ্টা সত্ত্বেও নিভে যায় ফারুক আহমদ পাটোয়ারীর জীবনপ্রদীপ। সহযোদ্ধারা তাঁর মরদেহ বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। একই এলাকায় ছিল তাঁর গ্রামের বাড়ি। পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
ফারুক আহমদ পাটোয়ারী চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালের মার্চে ছুটিতে বাড়িতে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে যুদ্ধ করেন ২ নম্বর সেক্টরের নির্ভয়পুর সাব সেক্টরে।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য ফারুক আহমদ পাটোয়ারীকে মণোত্তর বীর প্রতীক খেতাব প্রদান করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১৪২।
ফারুক আহমদ পাটোয়ারীর পৈতৃক বাড়ি চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার হুগলি (পাটোয়ারী বাড়ি) গ্রামে। তাঁর বাবার নাম সোনা মিয়া, মা রতুননেছা। স্ত্রী জাহানারা বেগম। তাঁর দুই ছেলে এক মেয়ে। জাহানারা বেগম একটি জরাজীর্ণ টিনশেড ঘরে ছেলেদের সঙ্গে থাকেন।
সূত্র: প্রথম আলোর ফরিদগঞ্জ (চাঁদপুর) প্রতিনিধি এম কে মানিক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.