শহর-গ্রামে আবার লোডশেডিং by অরুণ কর্মকার

গ্রাম-শহরনির্বিশেষে ঘন ঘন লোডশেডিং চলছে। গভীর রাতে গ্রামাঞ্চল কিছু বিদ্যুৎ পাচ্ছে। আর লোডশেডিংয়ের কবলে তখন শহরাঞ্চল। কয়েক দিন হলো এ অবস্থা শুরু হয়েছে। তবে গতকাল বৃহস্পতিবার বিদ্যুৎ-পরিস্থিতি ছিল খুবই খারাপ।


ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ ফোন করে ‘গ্রীষ্ম শুরু হতে না হতেই হঠাৎ এ রকম বিদ্যুতের আসা-যাওয়ার কারণ’ জানতে চান। বিভিন্ন বিতরণ কোম্পানির কাছে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অবস্থা সব জায়গাতেই খুব খারাপ ছিল।
তবে ব্যতিক্রম চাঁপাইনবাবগঞ্জ। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর জেলা ও নির্বাচনী এলাকা হওয়ায় সেখানে কোনো লোডশেডিং হচ্ছে না।
ঢাকার পরিস্থিতি: ঢাকার বিভিন্ন এলাকা এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য পাঠক টেলিফোনে প্রথম আলোকে জানান, গতকাল সকাল থেকেই লোডশেডিং শুরু হয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোডশেডিংকবলিত এলাকাও বাড়তে থাকে। বিকেল পর্যন্ত এলাকাভেদে চার থেকে পাঁচবার লোডশেডিং হয়েছে ওই সব এলাকায়।
অভিজাত এলাকা গুলশানে লোডশেডিংয়ের মাত্রা ছিল আরও বেশি। গুলশানের বেশির ভাগ এলাকায় এক ঘণ্টা পরপর লোডশেডিং হয়েছে। কোথাও কোথাও দুবার লোডশেডিংয়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান ছিল আরও কম। এ ছাড়া উত্তরা, টঙ্গী, কল্যাণপুর প্রভৃতি এলাকায়ও ঘন ঘন লোডশেডিং ছিল।
এই এলাকাগুলো ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির (ডেসকো) আওতাধীন। এত লোডশেডিংয়ের কারণ জানতে চাইলে ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরাও প্রচুর লোডশেডিংয়ের অভিযোগ পাচ্ছি। বিদ্যুৎ সরবরাহ কম থাকায় এই অবস্থা হয়েছে।’ তিনি বলেন, গুলশানে দিনের বেলায় সর্বোচ্চ চাহিদা ৬০ মেগাওয়াট। গতকাল পাওয়া গেছে সর্বোচ্চ ২০ মেগাওয়াট। ডেসকোর পুরো এলাকায় এখন দিনের বেলায় সর্বোচ্চ চাহিদা প্রায় ৫০০ মেগাওয়াট। গতকাল পাওয়া গেছে অর্ধেকেরও কম।
ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, তাঁদের আওতাধীন এলাকায়ও গতকাল দিনের বেলা ‘প্রচণ্ড লোডশেডিং’ ছিল। কারওয়ান বাজার, রাজাবাজার, জিগাতলা, মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, বাসাবো, শ্যামপুর, মানিকনগর প্রভৃতি এলাকায় গতকাল দিনের বেলা চার-পাঁচবার লোডশেডিং হয়েছে। তাঁরাও জানান, এর কারণ চাহিদার তুলনায় সরবরাহ অনেক কম ছিল।
ঢাকার বাইরের অবস্থা: ঝালকাঠি, খুলনা ও সিরাজগঞ্জে খবর নিয়ে জানা গেছে, দিনের বেলা এসব অঞ্চলেও ঘন ঘন লোডশেডিং হয়। গতকাল তা ছিল ব্যাপক। প্রথম আলোর নোয়াখালী ও বগুড়া কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, সেখানেও লোডশেডিংয়ে মানুষ ছিল অতিষ্ঠ।
এসব এলাকা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) আওতাধীন। পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বোর্ডের একাধিক সদস্য এবং চারটি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির (পবিস) চারজন মহাব্যবস্থাপক প্রথম আলোকে বলেন, যেখানে সরবরাহ অপেক্ষাকৃত বেশি, সেখানে চাহিদার অর্ধেকের মতো বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে। তাঁরা বলেন, এমনকি সেচের কারণে রাত ১১টা থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত গ্রামাঞ্চলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেওয়ার সরকারি ঘোষণাও কার্যকর হচ্ছে না। যেসব সেচ এলাকা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) আওতাধীন, সেখানে আরইবির এলাকার তুলনায় লোডশেডিং কম হয়।
আরইবি সূত্র জানায়, বর্তমানে তাদের সর্বোচ্চ চাহিদা তিন হাজার মেগাওয়াটের বেশি। পাওয়া যাচ্ছে দুই হাজার মেগাওয়াটের কম।
শহরে গভীর রাতে: সারা দিনের লোডশেডিংয়ের পর সন্ধ্যা ছয়টা থেকে শুরু হয় সর্বোচ্চ চাহিদার সময়ের (পিক আওয়ার্স) নির্ধারিত লোডশেডিং। এই সময় সবচেয়ে বেশি লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ছে গ্রামাঞ্চল। এরপর রাত ১১টা থেকে সেচের জন্য গ্রামাঞ্চলে সরবরাহ শুরু করা হলে, গভীর রাতে শহরে লোডশেডিং শুরু হয়।
এখন পর্যন্ত গভীর রাতের এই লোডশেডিং দুই বারে সীমিত আছে। তবে শিগগিরই সেচের জন্য বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহ যত বাড়বে, শহরাঞ্চলে গভীর রাতের লোডশেডিং ততই বাড়বে।
গতকাল ঢাকার বাসিন্দাদের মধ্যে আইপিএস, ইউপিএস প্রভৃতি বিকল্প বিদ্যুৎ ব্যবস্থার বিষয়ে তৎপরতা দেখা গেছে। কেউ পুরোনো আইপিএস মেরামত করাতে, কেউ বা নতুন কিনতে উদ্যোগী হয়েছেন।
কেন এত লোডশেডিং: পিডিবির সিস্টেম কন্ট্রোল ও জনসংযোগ পরিদপ্তর থেকে জানানো হয়, গতকাল তাদের সর্বোচ্চ উৎপাদনের লক্ষ্য ছিল চার হাজার ৮৪৬ মেগাওয়াট। চাহিদা ধরা হয় পাঁচ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। এই হিসাবে ঘাটতি ছিল ৬৫৪ মেগাওয়াট। তবে এই হিসাব দেখে প্রকৃত ঘাটতি বোঝা যাবে না।
বিতরণ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা জানান, পিডিবির ওই হিসাব বিশেষ করে, চাহিদার হিসাব কখনোই সঠিক ছিল না, এখনো নেই। দ্বিতীয়ত, ওই হিসাব সন্ধ্যাকালীন সর্বোচ্চ চাহিদা ও সরবরাহের। আজকাল দিনের বেলা তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো প্রায় বন্ধই করে রাখা হয়। ফলে দিনের সর্বোচ্চ চাহিদার সময় উৎপাদন সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াটের মধ্যে সীমিত থাকে। কিন্তু গরম পড়তে শুরু করায় এ সময় চাহিদা হয় প্রায় পাঁচ হাজার মেগাওয়াট। এ কারণে দিনের বেলায় সারা দেশে ঘন ঘন লোডশেডিং করতে হচ্ছে।
তেলচালিত কেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখার কারণ হিসেবে সূত্রগুলো জানায়, একদিকে উচ্চমূল্যের তেলের ব্যবহার সীমিত রেখে বিদ্যুৎ খাতের লোকসান কমিয়ে রাখা এবং সব কেন্দ্রে প্রয়োজন অনুযায়ী জ্বালানি তেলের সরবরাহ সংকট এর কারণ।
এ ছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদনে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ না থাকায় সন্ধ্যাকালীন সর্বোচ্চ চাহিদার সময়ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ লোডশেডিংমুক্ত: সারা দেশে বিদ্যুতের এ সংকটের মধ্যেও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর জেলা ও নির্বাচনী এলাকা চাঁপাইনবাবগঞ্জে কোনো লোডশেডিং নেই। গতকাল সন্ধ্যায় সেখানকার বিভিন্ন এলাকার চার ব্যক্তির কাছে বিদ্যুৎ-পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রথম আলোকে তাঁরা বলেন, কোনো লোডশেডিং নেই। তাঁরা বলেন, গত বছরও চাঁপাইনবাবগঞ্জে কোনো লোডশেডিং ছিল না। তাঁদের একজন রসিকতা করে বলেন, সারা দেশটাই যদি বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা হতো, তাহলে সারা দেশটাই লোডশেডিংমুক্ত থাকত।
ঢাকার স্পর্শকাতর এলাকা: ডিপিডিসির সূত্রগুলো জানায়, এ বছর গ্রীষ্মে ঢাকার কয়েকটি এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি খুব খারাপ হতে পারে। এর মধ্যে ডিপিডিসির কামরাঙ্গীরচর, লালবাগ, নারিন্দা, মুগদাপাড়া বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের আওতাধীন এলাকাগুলো রয়েছে।
এসব এলাকার বিতরণব্যবস্থা চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহের অনুপযোগী। এসব বিভাগে উপকেন্দ্র, সরবরাহ লাইন, ট্রান্সফরমার—সবই চাহিদা অনুযায়ী বিতরণের অনুপযোগী (ওভারলোডেড)।

No comments

Powered by Blogger.