প্রাণের আনন্দ আত্মার শান্তি by লিলি ইসলাম

আমার জন্ম হয়েছে কলকাতায়। মা আমাকে ঘুম পাড়াতেন রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে। অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছাত্রী ছিলেন। অনেক গানের মধ্যে একটি গান গাইতেন_'যে রাতে মোর দুয়ারগুলি'। সেই থেকে পরিচয় হয় রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্মের সঙ্গে।


আমার যখন পাঁচ বছর বয়স, তখন রাজগির বেড়াতে গিয়ে একটি অনুষ্ঠানে বহু শ্রোতার সামনে গান গেয়েছিলাম 'হে ক্ষণিকের অতিথি'। ভয়-দ্বিধা-সংকোচ-লজ্জা কোনোটাই ছিল না। হয়তো এটা পেয়েছি আমার পরিবারের কাছ থেকে। মা ছাড়া আমাদের বাড়িতে কেউ গান গাইতেন না। তাঁর গান সবাই খুব শুনতো। রাতেরবেলা আমার সেজকাকার সঙ্গে গলা ছেড়ে গান গাইতাম, আর মা আমাকে উৎসাহ দিতেন। মা অনেক গল্প বলতেন শান্তিনিকেতনের। মায়ের হাত ধরে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি দেখা, জীবনস্মৃতি পড়া, স্কুলের অনুষ্ঠানে নাচ-গানে অংশগ্রহণ করা এবং গীতবিতান সংগীত শিক্ষায়তনের গান শিখতে শুরু করা_সব কিছুই আমার জীবনে বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল। মা লং-প্লেয়িং রেকর্ড কিনে আনতেন। তার ওপর কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, তাঁদের ছবি দেখতাম আর কত কী যে কল্পনা করতাম, তা বলে বোঝাতে পারব না। কখন যে রবীন্দ্রনাথময় হয়ে গেছি, তা নিজেই জানি না। এরপর আমার শান্তিনিকেতনের জীবন আমাকে আর কোনো কিছু ভাবতে দেয়নি। ভাবার অবকাশ পাইনি। আর একটি বিষয় আমাকে পেছন দিকে টেনে নিয়ে যায়। এখনো চোখের সামনে সেই ছবিগুলো ভাসতে থাকে, আমার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে সেই দিনগুলোতে। কত সহজ-সরল অকপট ভাবনা-উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল আমাদের মধ্যে। রবীন্দ্রজয়ন্তী এলেই কলকাতার পাড়ায় পাড়ায়, বাড়িতে বাড়িতে কী যেন এক উৎসবের আমেজ তৈরি হতো। কয়েকদিন আগে থেকেই মহড়া শুরু হতো। ২৫ বৈশাখের দিন বাড়ির ছাদে আমরা ছোটরা অনুষ্ঠান করতাম। চৌকি পেতে স্টেজ বানানো হতো। মায়ের শাড়ি দিয়ে স্টেজের পর্দা টাঙানো, পরনে মায়ের শাড়ি, ছেলেদের পরনে বাবা চাচার ধুতি, সে কী ব্যস্ততা, কী সাজ সাজরব। বড়রাও আমাদের সঙ্গে যেন মেতে উঠতেন এই মহোৎসবে। এর সঙ্গে থাকতো আবার পাড়ার অনুষ্ঠান। দুই-এক কথায় এই অনুভূতি প্রকাশ করা সম্ভব না। সব ধরনের গান গাইতে শুরু করেছিলাম তখন। ঘুরে ফিরে সেই রবীন্দ্রনাথেই হতো আমার আশ্রয়। স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম শান্তিনিকেতনের।
ভেবে অবাক হই, একজন মানুষ এক জীবনে এত কাজ কী করে করলেন? কম্পিউটার তো ফেল! তাঁর মাথার মধ্যে যে ভাবনা-চিন্তা-কল্পনা-নতুন নতুন সৃষ্টির বীজ রোপিত ছিল_এ কী সম্ভব? যখন যা ভেবেছেন তাই করেছেন। ভ্রমণের নেশা তাঁর এই সৃষ্টির পথকে আরো সুগম করেছে। আমার মনের কথা তিনি কেমন করে জানলেন? আমার এমনই মনে হয় গীতবিতান বা রবীন্দ্ররচনার পাতা যখন উল্টাই। কই, আমি তো এমন করে বলতে পারি না। যত দিন যাচ্ছে, ততই ভাবিয়ে তুলছে আমাকে। জানি এই ভাবনার কোনো শেষ নেই। এই মানুষটাকে জানাচেনা, বোঝা এক জনমে সম্ভব নয়।
বিশ্বের দরবারে বাঙালি জাতি যে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে, এ-তো তাঁরই অবদান। তাই গলা ছেড়ে গাইতে ইচ্ছে করে তাঁরই গান
'আকাশভরা সূর্য তারা বিশ্বভরা প্রাণ
তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান।'
যত দিন যাচ্ছে ততই তাঁর লেখাগুলো নতুনভাবে ধরা পড়ছে আমার ভাবনায়। গল্পগুচ্ছের গল্পগুলো যখন পড়ি, তখন আমি নিজের মনে এক-একটা চরিত্র হয়ে উঠি। ইচ্ছাপূরণ আমার মনে আমার ছেলে হয়ে যাওয়ার ইচ্ছা জাগায়। শেষরক্ষা পড়ে কখনো আমি ইন্দুমতী হই, কখনো কমলমুখী। রবীন্দ্রসাহিত্যে নারী চরিত্রের স্থান অতুলনীয়। সামাজিক অবক্ষয়, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে নারীদের রুখে দাঁড়ানো এক বিরল ঘটনা। খ্যাতির বিড়ম্বনার প্রহসনের মধ্যেও যে নান্দনিক ভাবনা, তা অন্য কারো লেখনীতে খুব কম পাই। রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র থেকে কত যে নতুন কিছু শিখি, তা বলার নয়। রবীন্দ্রকাব্যে বিশ্বযুদ্ধের পরিণতি যেমন আছে, তেমনি আছে চূড়ান্ত রোমান্টিকতা। তাঁর লেখনীতে স্বদেশি ভাবনায় উদ্বুদ্ধ যেমন হই, তেমনি কল্পনায় ডুবে যেতে ইচ্ছে করে। এমনকি রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবিও যেন সাহিত্যের ভাষায় ভরপুর। যখন সংগীতচিন্তা পড়ি, তখন মনে হয় সংগীতের নন্দনতত্ত্বের এর চেয়ে ভালো বই বুঝি আর নেই। কারো সঙ্গে কারোর তুলনা করতে চাই না। তবে এটুকু বলতে পারি, এক-একজন এক-এক দিকে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন, দিকপাল হয়েছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এক সম্পূর্ণ রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ চিরকাল সুন্দর ও সত্যের সন্ধান করেছেন। তাঁর গান যুগে যুগে তাঁকে নতুনভাবে আবিষ্কার করবে সবার মাঝে। রবীন্দ্রনাথের গান প্রাণের আনন্দ, আত্মার শান্তি।

No comments

Powered by Blogger.