আলোচনার ঊর্ধ্বে রবীন্দ্রনাথ by কুমার বিশ্বজিৎ

রবীন্দ্রনাথ মানবতার কবি ও বিশ্বের কবি। তিনি বলার, প্রশংসার এবং সমালোচনার ঊধর্ে্ব। রবীন্দ্রনাথ এমন এক ব্যক্তিত্বের নাম, যাঁকে নিয়ে সারা পৃথিবীর মানুষ গর্ব করতে পারে। তিনি হচ্ছেন সবার ওপরে। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বলার কিছু নেই, তবে গর্ব করার বিষয় আছে। আমাদের গর্ব যে তিনি এশিয়া মহাদেশে জন্ম নিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলার ধৃষ্টতা আমার নেই। তবুও এটুকু বলতে পারি যে এত বড় মহান একজন মানুষ যিনি এই ক্ষুদ্র মানুষকে প্রচণ্ডভাবে আকর্ষণ করে।
আমাদের পরিবার ছিল একান্নবর্তী পরিবার। আমার দাদা, বাবা ও চাচারা রবীন্দ্রগানে আসক্ত ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই আমার ঘুম ভাঙত রবীন্দ্রনাথের গান শুনে। তখন থেকেই রবীন্দ্রগানের প্রতি ভালোলাগা। পরবর্তীকালে গান গাওয়া যখন শুরু করলাম, তখন বুঝতে পারলাম রবীন্দ্রনাথের গানের মাহাত্ম্য। কত আধুনিক মানসিকতার ছিলেন তিনি। তাঁর গান গভীরভাবে উপলব্ধি করলে বোঝা যায়, তাঁর গানের মধ্যে রয়েছে কাব্য, সাহিত্য ও অন্তমিল। রয়েছে পাশ্চাত্যের সুরের মিশ্রণ। গানের মধ্যে এমন কোনো বিষয়বস্তু নেই যা খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রেম, বিরহ, বিচ্ছেদ, দেহতত্ত্ব, দেশপ্রেম সব কিছু তাঁর সৃষ্টিকর্মের মধ্যে পাওয়া যায়।
রবীন্দ্রনাথের গানের ব্যাপ্তি এত যে তাঁর গান সম্পর্কে বলতে গেলে অল্প সময়ে শেষ করা যাবে না। এক সময় ভালোলাগা থেকে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া শুরু করলাম। আমার জীবনের প্রথম গান গাওয়া শুরু হয় রবীন্দ্রনাথের গান দিয়েই। রেডিওতে রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী হিসেবেই তালিকাভুক্ত ছিলাম। ১৯৭৪-১৯৭৭ সাল পর্যন্ত প্রচুর রবীন্দ্রসংগীত গাই। রবীন্দ্রনাথ এমনই এক ব্যক্তিত্বের নাম, যিনি একসঙ্গে দুটি দেশের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা। একজন মানুষ সংগীতে কতটুক সার্থক, তা শুধু তাঁর গানের জনপ্রিয়তা দেখলেই বোঝা যায়। যে গান কয়েক যুগ আগে সৃষ্টি হয়েছিল, তা এখনো সমান জনপ্রিয়। রবীন্দ্রনাথের গানের ভাণ্ডার থেকে একটি গান বেছে নেওয়া কঠিন, তবে আমি যখন একা থাকি তখন আমার মনে বাজতে থাকে 'যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে, আমি বাইবো না, বাইবো না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে।' আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে তাঁর বাউলতত্ত্বের দিকটি। তিনি লালনের আখড়াতেও যেতেন। কুঠিবাড়ীতে তাঁর থাকার অন্যতম কারণ ছিল লালনের সানি্নধ্য পাওয়া। লালনতত্ত্ব নিয়ে তিনি গবেষণা করেছেন, যার প্রতিফলন পাওয়া যায় গানের মধ্যে। তবে দুঃখের বিষয়, রবীন্দ্রনাথের গানগুলো এ প্রজন্মের কাছে তেমনভাবে প্রচার পায়নি। এই ব্যর্থতার জন্য আমরা শিল্পীরাও কোনো অংশে কম দায়ী নই। জাতীয়ভাবে আমাদের যে দায়িত্ববোধ ছিল, তা আমরা যথাযথভাবে পালন করতে পারিনি। বিভিন্ন একাডেমী স্থাপন ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে রবীন্দ্রসংগীতকে আরো জনপ্রিয় করা যেত। কিন্তু আমরা তা করতে ব্যর্থ হয়েছি। এখন দরকার যথাযথ পৃষ্ঠপোষকের, কিন্তু আমরা সেটাও পাচ্ছি না।
রবীন্দ্রনাথ বিশ্বের বিভিন্ন জাতির মানুষের সঙ্গে মিশেছেন, তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করেছেন। রবীন্দ্রনাথই বাংলাদেশের মারফতি, বাউল গান বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছেন। বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন আমাদের হাজার বছরের লালন করা সংস্কৃতি। নতুন প্রজন্মের অনেকে রবীন্দ্রনাথের গান গাইছে। তবে প্রশ্ন থেকে যায় সেসব গানে বাণী ও সুর কতটুকু রক্ষিত হচ্ছে? তবে আশার কথা, চর্চা শুরু হয়েছে, পরিশুদ্ধ হতে সময় লাগবে।
রবীন্দ্রনাথের গান আমাকে আকর্ষণ করে। তাই একটি গান আমি আমার 'সাঁঝবেলা' অ্যালবামে গেয়েছিলাম। গানটি গাওয়ার সময় প্রচণ্ড আড়ষ্ট ছিলাম। রবীন্দ্রনাথের গানগুলো বাণীপ্রধান। আমি কী পারবো গানের বাণী ও সুরকে ঠিক রেখে গান গাইতে? গানটি গাওয়ার সময় স্বরলিপি, গায়কী ঢং ও সুর ঠিক রেখে গেয়েছি। গানটি প্রকাশিত হওয়ার পর প্রচুর প্রশংসা পেয়েছি, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি কোনো বিরূপ মন্তব্য আমাকে শুনতে হয়নি। বর্তমানে রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে অনেকে ব্যবসা করছেন। কিন্তু ব্যবসা এক জিনিস এবং সৃষ্টিশীলতা অন্য জিনিস। সৃষ্টিশীলতার দিক থেকে প্রত্যেক শিল্পীর চাওয়া থাকতে পারে রবীন্দ্রসংগীতের একটি অ্যালবাম বের করার। আমারও ইচ্ছা আছে রবীন্দ্রসংগীতের একটি পূর্ণাঙ্গ অ্যালবাম বের করার। যদি তা করতে পারি, তবে আমি নিজেকে সফল মনে করব। এ ক্ষেত্রে দায়িত্ব নেওয়ার প্রশ্ন থাকে। তবে আমি কারো দায়িত্বের ওপর বসে থাকব না।
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য নিয়ে আমি বেশি নাড়াচাড়া করি না। তবে তাঁর ছোটগল্পগুলো আমাকে চরমভাবে আকৃষ্ট করে। তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্যে পাওয়া যায় মানুষের গভীর জীবনবোধ। যখন আমি তাঁর ছোটগল্পগুলো পড়ি, তখন আমি চরিত্রের মধ্যে হারিয়ে যাই। কখনও আমি হয়ে যাই কাবুলীওয়ালা, আবার কখনও হয়ে যাই দুরন্ত ফটিক। যখন 'হৈমন্তী' পড়ি তখন হৈমন্তীর জন্য মন দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। মানুষের জীবনের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম দুঃখ-কষ্ট, হাসি-কান্না তিনি অত্যন্ত নিপুণভাবে তাঁর ছোটগল্পের মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন। 'সোনার তরী' কবিতায় তুলে ধরেছেন মানুষের জীবনের চরম সত্যকে। 'দুই বিঘা জমি' কবিতায় ফটিয়ে তুলেছেন ভূস্বামীদের অত্যাচারের কাহিনী।
তাঁর সৃষ্টিকর্ম গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, তিনি বিশ্বের অন্য বড় কবিদের চেয়ে অনেক বড়। তাই তাঁকে আমরা গর্বের সঙ্গে বলি 'বিশ্বকবি'। মানুষের জীবনের এমন কোনো অনুভূতি নেই, যেখানে তিনি ছুঁয়ে যাননি।
হাজার বছর পরেও হয়তো তাঁর মতো এমন মানুষ পৃথিবীতে আসবে না। আমরা তাঁর সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী পালন করছি। এই ১৫০ বছরে তাঁর মতো কোনো ব্যক্তিত্বের জন্ম এই পৃথিবীতে হয়নি। তাই তিনি ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। 'সোনার তরী' কবিতায় এই সত্যটিই প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।
শূন্য নদীর তীরে রহিনু পড়ি
যা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী
তিনি নেই কিন্তু তাঁর সৃষ্টিকর্ম আমাদের মধ্যে আছে। তাঁর সৃষ্টিকর্ম লিপিবদ্ধ থাকবে মহাকালের সাক্ষী হিসেবে। কর্মের মধ্য দিয়েই তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন যুগ যুগ ধরে।

No comments

Powered by Blogger.