চিকিৎসা-যে ব্যবস্থাপত্রে রোজা নষ্ট হয় না by ডা. এবিএম আবদুল্লাহ

ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের মধ্যে রোজা অন্যতম। প্রত্যেক মুসলিমের জন্য রমজানের এক মাস রোজা রাখা ফরজ। এ সময় একজন মুসলিমকে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যে কোনো খাদ্যদ্রব্য ও পানীয় গ্রহণ এবং মুখে ওষুধপত্র খাওয়া থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হয়।


অনেক সময় অনেক রোগী একদিকে যেমন রোজা রাখতে চান, তেমনি অন্যদিকে রোগের কারণে বিভিন্ন ওষুধপত্র সেবন করাটাও বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ায়, যা না করলে তার জীবন বিপন্নও হতে পারে। রোজা রাখা অবস্থায় অনেক রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা অপারেশনও জরুরি হয়ে পড়তে পারে। আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণে অনেক নতুন নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা আবিষ্কৃত হয়েছে, যা আগে ছিল না। যেমন ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে ওষুধ দেওয়া, ইনহেলার, রক্ত পরীক্ষা, এন্ডোস্কপি, কোলনোস্কপি, বায়োপসি ইত্যাদির যে কোনোটাই রোজাদার রোগীর জন্য জরুরি হয়ে পড়তে পারে। এমতাবস্থায় অনেক সময় রোজা পালনরত অবস্থায় রোগী এবং ডাক্তার উভয়েই রোজা রাখা না রাখা নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়েন। এমনকি অনেক ডাক্তারও সঠিক পরামর্শ দিতে দ্বিধাবোধ করেন।
এ সমস্যাগুলো সামনে রেখে রোজা রাখা অবস্থায় ওষুধ গ্রহণ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ইত্যাদির ব্যাপারে সারাবিশ্বের ইসলামী চিন্তাবিদ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা তাদের সুচিন্তিত অভিমত দিয়েছেন। তারা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, ইসলামী আলেম-ওলামাদের সঙ্গে কথা বলে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, রোজা থাকা অবস্থায় বেশ কয়েকটি পন্থায় ওষুধ সেবন ও বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে রোজা নষ্ট হবে না।
১৯৯৭ সালের জুনে মরক্কোতে 'ইসলামের দৃষ্টিতে সমসাময়িক চিকিৎসা সমস্যা' (অহ ওংষধসরপ ঠরব িড়ভ ঈবৎঃধরহ ঈড়হঃবসঢ়ড়ৎধৎু গবফরপধষ ওংংঁবং) শিরোনামে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এই সেমিনারের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল কী কী মেডিকেলজনিত কারণে রোজার ক্ষতি হয় না। পরে নবম ফিকাহ-মেডিকেল সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে যৌথভাবে বৈজ্ঞানিক, সাংস্কৃতিক এবং স্বাস্থ্য বিষয়ে আলোচনা হয়। এ আলোচনা যৌথভাবে জেদ্দার ইসলামিক ফিকাহ একাডেমী, মিসরের আল আজহার ইউনিভার্সিটি, আলেকজান্দ্রিয়ায় অবস্থিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক অফিস এবং ইসলামিক শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের (আইইএসসিকো) উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়। এই সেমিনারেও মূল আলোচ্য বিষয় ছিল কী কী ভাবে ওষুধ সেবনে বা পরীক্ষা করলে রোজা ভঙ্গ হয় না।
ইসলামিক চিন্তাবিদ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সর্বসম্মতিক্রমে এমন কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেন যাতে অসুস্থ ব্যক্তি রোজা রাখা অবস্থায় নিম্নলিখিত ব্যবস্থাপত্র নিলে এবং প্রয়োজনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করালে রোজা ভঙ্গ হবে না। এই সেমিনারের সিদ্ধান্ত ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে প্রকাশ করা হয়েছে।
১. রোজা রাখা অবস্থায় চোখ, কান ও নাকে ড্রপ নেওয়া যাবে।
২. হৃদরোগীর বেলায় বুকে ব্যথা হলে নাইট্রোগ্গি্নসারিন স্প্রে বা ট্যাবলেট জিহ্বার নিচে নিতে পারবেন।
৩. মহিলা রোগীর তলপেটে পরীক্ষার জন্য যোনিদ্বার দিয়ে ডাক্তার বা নার্স হাতের আঙুলে অথবা কোনো ডিভাইস প্রবেশ করালে রোজা ভাঙবে না। এমনকি চিকিৎসার জন্য যোনিপথে পেসারি বা কোনো ওষুধ ব্যবহার করা যাবে।
৪. মূত্রথলি পরীক্ষা বা এক্স-রে করার জন্য রোগীর প্রস্রাবের দ্বার দিয়ে ক্যাথেটার অথবা অন্য কোনো যন্ত্র প্রবেশ করালে অথবা রেডিও-ওপেক ডাই প্রবেশ করালে রোজা ভঙ্গ হবে না।
৫. দাঁত তোলা, ড্রিলিং করা বা মেসওয়াক বা ব্রাশ দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করা যাবে। তাতে রোজা ভঙ্গ হবে না। তবে যেন এগুলো করার সময় পাকস্থলীতে থুথু বা টুথপেস্ট প্রবেশ না করে।
৬. রোগীর চামড়া, মাংস, অস্থিসন্ধি ও শিরায় ইনজেকশন দেওয়া যাবে। কিন্তু স্যালাইন, ডেক্সট্রোজ, প্রোটিনজাতীয় জিনিস ইত্যাদি ব্যবহার করা যাবে না।
৭. যে কেউ রক্ত অন্যকে দিতে পারবেন আবার জরুরি প্রয়োজনে নিজেও নিতে পারবেন।
৮. কোনো রোগী অক্সিজেন অথবা অজ্ঞানকারী গ্যাস (এনেসথেসিয়া) নিলে রোজা ভঙ্গ হবে না।
৯. চর্মের মাধ্যমে শরীরের ভেতরে যায় এমন মলম, ক্রিম, অয়েন্টমেন্ট ইত্যাদি ব্যবহার করা যাবে।
১০. পরীক্ষার জন্য তার শরীর থেকে রক্ত নেওয়া যাবে।
১১. হৃদরোগে আক্রান্ত রোগী হার্টের এনজিওগ্রাম এবং কার্ডিয়াক ক্যাথেটার করা যাবে।
১২. রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বা চিকিৎসার অংশ হিসেবে এন্ডোস্কপি করলে রোজা ভঙ্গ হবে না।
১৩. মুখ পরিষ্কারের জন্য মাউথওয়াশ বা গড়গড়া বা মুখে স্প্রেজাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা যাবে। তবে যেন পাকস্থলীতে কোনো কিছু না যায়।
১৪. জরায়ু পরীক্ষার জন্য শরীরে হিস্টেরোস্কপি করা যাবে, এমনকি জরায়ুতে কোনো যন্ত্রপাতি বা অন্য কিছু পরীক্ষার জন্য প্রবেশ করালে রোজায় কোনো সমস্যা হবে না।
১৫. লিভার বায়োপসি অথবা অন্য কোনো অঙ্গের বায়োপসি করলে রোজা নষ্ট হবে না।
উপস্থিত অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ নিম্নে বর্ণিত ব্যবহার্যবিধিও অনুমোদন করেন, যেমন_
১. নাকে স্প্রে বা হাঁপানি রোগীর বেলায় ইনহেলার জাতীয় কিছু নিলে কোনো সমস্যা নেই।
২. রোগীর পায়ুপথে ইনজেকশন অথবা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আঙুল বা অন্য কোনো যন্ত্র প্রবেশ করালে রোজা ভঙ্গ হবে না।
৩. জরুরি কোনো অপারেশন প্রয়োজন হলে রোজা রাখা অবস্থায় করা যাবে।
৪. কিডনি অকেজো হলে রোগীর ডায়ালাইসিস করলে রোজা ভঙ্গ হবে না।
৫. পাকস্থলী পরীক্ষার জন্য গ্যাস্ট্রোস্কপি করা যাবে; কিন্তু কোনো তরল প্রবেশ করানো যাবে না।
এ মতামতগুলো নিয়ে অনেক রোগী এবং চিকিৎসকের মধ্যে বিভ্রান্তি হতে পারে; কিন্তু এই মতামতগুলো বিশ্বের ইসলামী চিন্তাবিদ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। তাই আমাদের দেশে চিকিৎসকরা এ মতামত রোগীদের দিলে রোগীরা যেমন সচেতন হবেন, তেমনি সঠিক নিয়মে রোজা পালন করতে পারবেন।
যদি কারও মনে কোনো বিভ্রান্তি দেখা দেয় বা দ্বিমত পোষণ করেন, তবে আমাদের দেশীয় আলেম-ওলামা, ইসলামী চিন্তাবিদ, জাতীয় মসজিদের ইমাম এবং ধর্মজ্ঞানসম্পন্ন চিকিৎসক একসঙ্গে বসে তাদের সুচিন্তিত অভিমতের মাধ্যমে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত জানাতে পারেন। প্রয়োজনে ধর্ম মন্ত্রণালয় উদ্যোগ গ্রহণ করলে তা অত্যন্ত কার্যকর হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

ডা. এবিএম আবদুল্লাহ :ডিন, মেডিসিন অনুষদ, বঙ্গবল্পুব্দ শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.