শ্রদ্ধাঞ্জলি-দ্যুতিময় চোখের মানুষটি by পারভেজ চৌধুরী

দ্যুতিময় চোখের লম্বা-চওড়া মানুষটাকে প্রথম দেখি জিএসএসের মিডিয়া সেন্টারে। পোশাক-আশাক, কথাবার্তায় এক লহমায় চোখ কেড়ে নেয়। খানিক দূর থেকে বুঝলাম, ক্যামেরায় ব্যাক ফোকাস নিয়ে অনেক জটিল আলাপ হচ্ছে। সঙ্গে ছিলেন প্রখ্যাত প্রামাণ্যচিত্র-নির্মাতা গুরু ফুয়াদ চৌধুরী।


জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে?’ চিনিয়ে দিলেন আশফাক মুনীর মিশুক। ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ায়। ক্যামেরায় কাজ করে। শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর ছেলে।
ব্যস, এটুকুই; তারপর বিভিন্ন স্থানে শুটিং করতে গিয়ে কথাবার্তা হয়নি, কিন্তু চোখে চোখে দেখা হয়েছে। সময়টা ’৯৭-৯৮ সাল। তখন আমরা যারা মিডিয়ায় কাজ করি, তাদের প্রাতিষ্ঠানিক পরিচিতি নেই, কিন্তু গনগনে স্বপ্ন আছে, বুকভরা আছে রোমাঞ্চ। সামনে চলার পথটা পাহাড়িয়া রাস্তার মতো শুধু পা ফেলার জায়গাটুকু দেখা পায়, বাকিটা থাকে অজানা। গুরু ফুয়াদ চৌধুরীর সঙ্গে কাজ করতে করতে পরিচয় ঘটে এক ব্রিটিশ সাংবাদিকের সঙ্গে। হ্যান্ডশেক। অনেক আলাপ করার পর যখন নামটা বলল, তখন সারা শরীরে আরেক শিহরণের বিদ্যুৎ খেলে গেল—সেই বিখ্যাত সাংবাদিক সাইমন ড্রিং, যিনি ১৯৭১ সালে প্রথম বিশ্ববাসীকে জানিয়েছিলেন বাংলাদেশে ২৫ মার্চ গণহত্যা হয়েছে। সাইমন ড্রিং আমন্ত্রণ জানাল, এসো, আমরা খণ্ড খণ্ড স্বপ্ন একত্র করে একটি বড় স্বপ্ন গড়ি আর স্বপ্ন মানেই ইতিহাস। এই ইতিহাস হবে একটি প্রাইভেট টেরেস্ট্রিয়াল টেলিভিশনের। নাম একুশে। শুরু হলো পথ চলা। এ চলা প্রথা ভাঙার, জীবনের সঙ্গে জীবনকে মিশিয়ে জীবনকে দেখার। প্রযোজক হিসেবে একুশে টেলিভিশনে যোগ দিয়ে বনানীর একটি বিল্ডিংয়ের হলঘরসমেত অফিসে ঢুকেই চোখ আটকে গেল একেবারে কোনার জানালার পাশে বসে কম্পিউটারে কর্মরত আশফাক মুনীর মিশুকের দিকে। ভীরু অথচ দৃপ্ত পায়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। হাসিমাখা ঠোঁটে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী পারভেজ, জয়েন করলা?’ বুকটা ভরে গেল, আরে, ইতিমধ্যে আমার নামটাও জেনে নিয়েছে! একুশে টিভিতে যোগ দেওয়ার শুরুতেই আমাদের একাত্তর নামে একটি দীর্ঘ ধারাবাহিক অনুষ্ঠানের দায়িত্ব দেওয়া হলো আমাকে। এটির উপস্থাপক ও গবেষক ছিলেন প্রখ্যাত লেখক, গবেষক ও সাংবাদিক আফসান চৌধুরী। এই ধারাবাহিক প্রামাণ্যচিত্রে ২৫ মার্চের কালরাতের জগন্নাথ হলের গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া প্রত্যক্ষদর্শী ঝাড়ুদার থেকে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের নীতিনির্ধারকদের সাক্ষাৎকার নিতে হতো। আমাদের একাত্তর প্রামাণ্যচিত্রটি একুশে টিভির তো বটেই, আমারও একটি প্রাণের কাজ ছিল। যোগ দেওয়ার দুই-তিন দিনের মধ্যে বস আশফাক মুনীর মিশুক প্রিয় মিশুক ভাই হয়ে গেলেন। খুব নিষ্ঠার সঙ্গে মিশুক ভাই আমাদের একাত্তর-এর প্রতিবারের শুটিং শেষে জানতে চাইতেন, কী কী হলো? বুঝতে চাইতেন ঘটনার পরিক্রমা, ইতিহাসের বয়ান, মহান মুক্তিযুদ্ধের বিস্তৃতি। শুধু শুনে যেতেন আর স্বভাবসুলভ টুকটাক প্রশ্ন করতেন। প্রায় সময়ই অফিসের কাজ রেখে চলে যেতেন আমাদের একাত্তর-এর শুটিংয়ে। নিজে চিত্রগ্রহণ করতেন মাথায় গামছা পেঁচিয়ে। শুটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে আলাপ হতো অনেক। দেখলাম, কথা কম, কাজ বেশি ধাঁচের লোক। প্রশ্ন করলে অনেক উত্তর দেয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অদম্য। অনড় ক্ষ্যাপাটে। প্রযুক্তিঘনিষ্ঠ। পৃথিবীর ব্রডকাস্ট মিডিয়ার সব আপডেট তাঁর কাছে আছে। কর্মপাগল। শিক্ষকতার বেড়াজাল নেই, করপোরেট নিয়মকানুনের বালাই নেই। কেমন যেন বাউল বাউল টাইপের দারুণ মিশুক, বন্ধুবৎসল। দিনের পর দিন তাঁর ওপর আমাদের নির্ভরশীলতা বাড়তে থাকে। শুটিংয়ের কোথাও কোনো সমস্যায় পড়লে ফোনে মিশুক ভাইয়ের সমাধান চাইতাম। সাতক্ষীরায় একটি গ্রামে শুটিং করতে যাব। পাখির কিচিরমিচির অডিও কীভাবে নেব? কিংবা কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকায় শুটিংয়ের সময় হাওরের পানির অডিও কী করব? দেশীয় প্রযুক্তিতে সব অদ্ভুত অদ্ভুত সমস্যার যুক্তিগ্রাহ্য সমাধান ছিল মিশুক ভাইয়ের কাছে। বাহ্, মানুষটা মজার তো! তাঁর পেছনে ফেউ লাগা যায়। তাঁর অজান্তেই তাঁকে অনুসরণ করা শুরু করলাম। অল্প সময়ে আমাদের প্রফেশনাল আইকন হয়ে গেলেন। তাঁর মধ্যে প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও আইডিয়া উভয়ের দারুণ সমন্বয় ছিল। ঢাকায় যেখানেই মিশুক ভাইয়ের শুটিং হতো, চলে যেতাম শুটিং স্পটে। চুপচাপ শুটিং দেখতাম, পর্যবেক্ষণ করতাম। মাল্টি পকেটের শুটিং প্যান্ট পরা মিশুক ভাইয়ের এক পকেটে প্লায়ার্স, তো সে পকেটে স্কচ টেপ, আরেক পকেটে ব্যাটারি তো অন্য পকেটে টর্চলাইট। চমৎকার তাঁর পেশাদারি! শুরুর দিকে অনেক সময় আমাদের সারা রাত জেগে কাজ করতে হতো। তিনিও রাতজাগা দলে ভিড়ে যেতেন তাঁর নিজস্ব কাজ নিয়ে।
সড়ক দুর্ঘটনায় যখন প্রিয় মানুষটার মৃত্যুর খবর শুনলাম, টেলিভিশনে দেখলাম বহন করা গাড়িটি দুমড়েমুচড়ে পড়ে আছে রাস্তার ওপর, পাশে নিথর দেহটা, ছানি পড়া চোখের মতো সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসে চারপাশ। মনে হয়, এখনই ফোন করলে মিশুক ভাই ফিক করে হাসি দিয়ে অনন্তকাল বলে যাবেন—আমি ‘অন দ্য ওয়ে...’
পারভেজ চৌধুরী অনুষ্ঠানপ্রধান, দেশ টিভি

No comments

Powered by Blogger.