'তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা' by মেহের আফরোজ শাওন

আমার বয়স যখন ছয় কী সাত, তখন ধারণা ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বুঝি শুধু নৃত্য প্রতিযোগীদের জন্যই গান করেছেন। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ শিশু একাডেমী আয়োজিত জাতীয় শিশু প্রতিযোগিতায় 'বধু কোন আলো লাগলো চোখে' গানটির সঙ্গে আমার নৃত্যে অংশগ্রহণ।


'ছিল মর্মবেদনা ঘন অন্ধকারে
জনম জনম গেল বিরহ শোকে'
ছয় বছর বয়সী আমি এই কথাগুলোর অর্থ বুঝব না_এটাই স্বাভাবিক। তাই আমার নৃত্যগুরু শুক্লা সরকার এবং আমার মা গানের কোন জায়গায় একটু হাসতে হবে আর কোন জায়গায় দুঃখী দুঃখী ভাব করতে হবে, তা আমাকে পুরোই মুখস্থ করিয়ে দিলেন। এরপর আরো অনেক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি। প্রতিবারই রবীন্দ্রনাথের গানের কাছে হাতপাতা।
'ফুলে ফুলে ঢোলে ঢোলে বহে কি বা মৃদু বায়'

'এসো নীপবনে ছায়াবীথি তলে
এসো কর স্নান নবধারা জলে'
কিংবা
'মোর ভাবনারে কি হাওয়ায় মাতালো
দোলে মন দোলে অকারণ হরষে।'

খুবই অবাক হলাম যখন দেখলাম তিনি আমাকে নিয়ে একটি গান লিখেছেন!

'শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা নিশীথ যামিনীরে'

এই গানটির সঙ্গে নতুন কুঁড়ি ১৯৮৮-তে যখন রুমানা রশিদ ঈশিতা নৃত্য পরিবেশন করল, তখন আট বছর বয়সী আমার ভয়ংকর রাগ হলো। পুরো সময়টা আমি মুখ ভোঁতা করে বসে ছিলাম। এমনকি নিজের নৃত্য পরিবেশনটিও মুখ ভোঁতা করেই করেছিলাম। ঈশিতা যখন সেই প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হলো তখন আমার মনে হলো, আমার শাওন গগনে গানটির জন্যই ওর এই সাফল্য।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার নতুন করে পরিচয় ঘটে ১৯৬৬ সালে 'নক্ষত্রের রাত' ধারাবাহিক নাটকের সেটে। সার্কিট হাউস রোডের ডিএফপিতে সেট ফেলে প্রতিদিন সন্ধ্যায় শুটিং হতো। সঙ্গে চলত জমজমাট আড্ডা। শটের জন্য যাঁর ডাক পড়ত তিনি অনেক কষ্টে ডিএফপির টানা বারান্দার আড্ডা ছেড়ে মুখ ভোঁতা করে শট দিতে যেতেন। মাঝেমধ্যে গানের আসর বসত। জনপ্রিয় গায়ক সেলিম চৌধুরী ছিলেন সেইসব আসরের প্রধান নায়ক। পুরো বাংলাদেশ তখন তাঁর 'আইজ পাশা খেলব রে শ্যাম'-জ্বরে আক্রান্ত। সেলিম ভাই আমাদের হাছন রাজার চমৎকার সব অপ্রচলিত গান শোনাতেন। আর আমি গাইতাম দু-একটা রবীন্দ্রসংগীত। (ওই যে ছোটবেলায় নাচের সময় যেগুলো শুনতাম সেগুলোই)। হঠাৎ একদিন 'নক্ষত্রের রাত' নাটকের পরিচালক হুমায়ূন আহমেদ আমাকে অরুন্ধতী হোম চৌধুরীর একটি এলপিআর (লং প্লে রেকর্ড) দিয়ে বললেন, এখানে কয়েকটি অপ্রচলিত রবীন্দ্রসংগীত আছে। তুমি তো রবীন্দ্রসংগীত ভালোই গাও। এই গানগুলো শিখে রেখো।
বাসায় ফিরে গানগুলো শুনলাম। একটি গানের লাইন সারা রাত আমার মাথার ভেতর ঘুরতে লাগল।
'চরণ ধরিতে দিয়োগো আমারে
নিও না নিও না সরায়ে
জীবন মরণ সুখ দুখ দিয়ে
বক্ষে ধরিব জড়ায়ে।'

এত সুন্দর গানও হয়?

পরবর্তী কয়েক দিন ঘোরের মধ্যে কাটল। দোকানে রবীন্দ্রসংগীতের যত ক্যাসেট (তখনো সিডি আসেনি) সব জোগাড় করলাম।

'মাঝে মাঝে তব দেখা পাই চিরদিন কেন পাই না
কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে তোমারে দেখিতে দেয় না।'

'তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা
এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা।'

'মেঘের পর মেঘ জমেছে আঁধার করে আসে
আমায় কেন বসিয়ে রাখো একা দ্বারের পাশে।'

'আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়
আমি তার লাগি পথ চেয়ে আছি পথে যে জন ভাসায়।'

এ রকম আরো কিছু গান আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখল। আমি রবীন্দ্রসংগীতের প্রেমে পড়ে গেলাম। এই আচ্ছন্নতা, এই রবীন্দ্রপ্রেম আমার এখনো আছে, সব সময় থাকবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবর্ষপূর্তিতে আমার সেই ঘোরলাগা গানগুলো থেকে আটটি গান সিডি আকারে নিবেদন করছি। আহারে! আমার ববীন্দ্রনাথের পায়ের কাছে বসে যদি তাঁকে গানগুলো শোনাতে পারতাম!

No comments

Powered by Blogger.