বল্পুব্দর জন্য দিবস by একরামুল হক শামীম

খুব সাদামাটা অর্থে বন্ধুত্ব একটা সম্পর্ক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, বন্ধুত্ব বলতে তিনটা পদার্থ বোঝায়। দুই ব্যক্তি ও একটা জগৎ। রবিঠাকুরের এই বক্তব্য থেকে বন্ধুত্বের সম্পর্কের একটা রূপ দাঁড় করানো যায়। গাণিতিক হিসেবে বন্ধুত্বের স্থান দুই এবং তিনে। অর্থাৎ যেখানে বন্ধু আছে সেখানে দু'জনে মিলে তৃতীয় একটা পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন থাকে।


বন্ধুত্বের এই চিরন্তন সম্পর্কটিই মানুষকে মহান করে তোলে। বন্ধুত্ব সেই আদিযুগের পরিসর থেকে বর্তমান সমাজে এসে তাৎপর্যময় অবস্থানে রয়েছে। সম্পর্কের অনেক গভীরে স্থান পেয়েছে বন্ধুত্ব। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন শিল্প ও বিজ্ঞানের সঙ্গে একই কাতারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন বন্ধুত্বকে। আমাদের নিরন্তর গবেষণায় প্রাপ্ত সবচেয়ে সৌন্দর্যময় জিনিসগুলো শিল্প, বিজ্ঞান আর বন্ধুত্ব। অ্যারিস্টটল একবার প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলেন, বন্ধুত্ব কী? তিনি খুব সহজ ভাষায় এর জবাব দিয়েছিলেন_ বন্ধুত্ব হলো দুটি দেহে একটি আত্মা। সভ্যতার শুরু থেকেই বন্ধু এবং বন্ধুত্বের মূল্য রয়েছে। যে সমাজে মানুষ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ ও জীবনধারণ করত সেই সমাজেও বন্ধুরা মিলে একসঙ্গে শিকারে যেত। এই যে মানুষ তার বন্ধুদের প্রতি এত আন্তরিক সেই উপলব্ধি থেকেই কেউ কেউ বন্ধুত্বের জন্য আলাদা একটা দিবস রাখার চিন্তাভাবনা শুরু করেন। সেই সময়টাতে ভালোবাসা দিবস, মা দিবস, বাবা দিবসের প্রচলন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। বন্ধুত্ব দিবস উদযাপন শুরু হয় ১৯১৯ সাল থেকে। তবে বর্তমান সময়ে আমরা যে পরিসরে বন্ধুত্ব দিবস পালিত হতে দেখছি তা শুরু ১৯৩৫ সালে। তখন আমেরিকার কংগ্রেস আগস্ট মাসের প্রথম রোববারকে জাতীয় বন্ধুত্ব দিবস ঘোষণা করে। তারপর প্রতি বছরই আমেরিকাতে বন্ধুত্ব দিবস পালিত হতে থাকে। বর্তমানে সারাবিশ্বেই আগ্রহ নিয়ে বন্ধুত্ব দিবস পালিত হচ্ছে। তবে অন্য অনেক দিবসের মতো বন্ধুত্ব দিবসও বিতর্কের ঊধর্ে্ব নয়। অনেকেই প্রশ্ন তোলেন, বন্ধুত্বের জন্য আলাদা দিবসের প্রয়োজন কেন? বন্ধুত্বের জন্য তো প্রতিদিনই রয়েছে। আবার অনেকে অভিযোগ করেন, ব্যবসায়িক সফলতার দৃষ্টিকোণ থেকে বন্ধু দিবসের পরিসর বাড়ানো হয়েছে। তবে এটা সত্যি যে, বিশ্বায়ন আর পুঁজি বাণিজ্য বন্ধুত্বের এ দিনটিকে বাণিজ্যকরণ করে ফেলেছে। এত কিছুর পরও বন্ধুদের জন্য নির্ধারিত এ দিনটিতে বন্ধুরা একসঙ্গে উদযাপন করে।
মহিনের ঘোড়াগুলো অ্যালবামের একটা গান আছে_ 'হাত বাড়ালেই বন্ধু সবাই হয় না, বাড়ালে হাত বন্ধু পাওয়া যায় না।' প্রকৃত বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। নাগরিক জীবনের ব্যস্ত মানুষগুলো যেন বন্ধুত্বের আসল স্বরূপ খুঁজে পাচ্ছে না। হুমায়ূন আহমেদের লেখা রূপা গল্পটিকে লোকটি নিজের জীবনের একটা ঘটনা বলার জন্য খুঁজে খুঁজে অপরিচিত লোক বের করে। তারপর সেই অপরিচিত মানুষটির কাছে তার জীবনের গল্পটি বলে। নাগরিক জীবনের ব্যস্ত মানুষগুলোর অবস্থাও কিছুটা এ রকম। বন্ধুত্বের আশ্রয় তারা হাতড়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত বন্ধুত্বের আশ্রয় তারা পাচ্ছে না। আর এ জন্যই মনের ভাবনা শেয়ার করতে খুঁজে খুঁজে অপরিচিত লোককে বের করছে। অনেকে আবার নিজেই নিজের বন্ধু হতে পারছে না। প্রকৃত বন্ধুর আশ্রয় ছেড়ে নিতে চাচ্ছে ভার্চুয়াল বন্ধুর আশ্রয়। কিন্তু চলমান সভ্যতার জন্য বন্ধুত্বের অনেক বেশি প্রয়োজন। প্রাচীন সময়ে গ্রিক এবং রোমানরা যেমন বুঝতে পেরেছিল ভালো সমাজ এবং ভালো জীবনের জন্য বন্ধুত্বের প্রয়োজন, বর্তমান সময়েও এ উপলব্ধিটাই প্রয়োজন। আর তাহলেই বন্ধুত্বের অবারিত প্রান্তর ধরে হেঁটে বেড়ানো যাবে। সুমন কবীরের 'চাইছি তোমার বন্ধুতা' গানের কথার মতোই আজ পৃথিবীময় চাইছি বন্ধুত্ব।
 

No comments

Powered by Blogger.