সাবান, লবণের প্রলোভনে প্রতারিত ১৪ হাজার নারী by সাইফুল হক মোল্লা

সদস্য হতে হলে ৩৬২ টাকা করে দিতে হবে! বিনিময়ে প্রতি মাসে একটি সাবান ও এক কেজি লবণ পাবেন। এভাবে একনাগাড়ে পাঁচ বছর চলবে। একজন সদস্য ন্যূনতম ৭২ জনকে সদস্য করতে পারলে সেই নারী সদস্যকে ব্যবস্থাপক করা হবে। ব্যবস্থাপকের মাসিক বেতন হবে এক হাজার ২৪০ টাকা।


এসব প্রতিশ্রুতির কথা শুনে কিশোরগঞ্জ সদর, নিকলী, পাকুন্দিয়া, মিঠামইন, কটিয়াদী ও করিমগঞ্জ উপজেলার দরিদ্র নারীরা ওই প্রতিষ্ঠানের জন্য সদস্য সংগ্রহ করেন। ৩১০ জন ব্যবস্থাপক প্রায় ১৪ হাজার সদস্য সংগ্রহ করেন। শুরুর তিন মাস লবণ ও সাবান ঠিকমতো দেওয়া হলেও পরে সেই কার্যক্রমে ভাটা পড়ে। অবশেষে মাস খানেক আগে বন্ধ হয়ে যায় প্রতিষ্ঠানটি। দরিদ্র নারীদের ৫০ লাখ টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যান প্রতিষ্ঠানটির প্রধান।
ওই প্রতিষ্ঠানের নাম মডেল ডিজিটাল বাংলাদেশ। এর প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার দানাপাটুলি ইউনিয়নের মাথিয়া গ্রামের আলামিন ফরাজি। এলাকায় তিনি পল্লিচিকিৎসক হিসেবে পরিচিত।
প্রতারণার শিকার ২৫ জন নারীর স্বাক্ষরসংবলিত একটি লিখিত অভিযোগ গত ২৭ ফেব্রুয়ারি কিশোরগঞ্জ সদর থানায় জমা দেওয়া হয়েছে। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর মোশাররফ হোসেন বলেন, প্রাথমিকভাবে প্রতারণার সত্যতা পাওয়া গেছে। তদন্ত শেষ হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জড়িত সবাই এখন পলাতক।
জানা যায়, বছর খানেক আগে আলামিন ফরাজি কিশোরগঞ্জ শহরের তারাপাশা মনিপুরঘাট এলাকায় একটি ভাড়া বাসা নিয়ে কার্যক্রম শুরু করেন। ২৮০ টাকা দিয়ে একজন নারীকে সদস্য করা হয়। তারপর ছবি ও পরিচয়পত্র বাবদ নেওয়া হয় আরও ৮২ টাকা।
প্রতারিত নারীরা এখন নারী ব্যবস্থাপকদের বাড়িতে গিয়ে টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন। একাধিক ব্যবস্থাপকের বাড়িতে হামলার ঘটনাও ঘটেছে।
প্রতারণার শিকার কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মনিপুরঘাট এলাকার চম্পা বেগম ও নাজমা বেগম জানান, শহরের বত্রিশ এলাকার সালমা আক্তারের মাধ্যমে সদস্য হয়ে ব্যবস্থাপক হয়েছিলেন। প্রায় আড়াই হাজার সদস্য বানিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি ‘হাওয়া’ হয়ে যাওয়ায় সদস্যদের চাপে এখন তাঁদের পক্ষে বাড়িতে থাকাও দুরূহ হয়ে পড়েছে।
‘প্রতিষ্ঠানটি’র ব্যবস্থাপকদের একজন সালমা আক্তার বলেন, ‘আলামিন ফরাজি পল্লিচিকিৎসক ছিলেন। তাঁর ভালো ব্যবহারে বিশ্বাস করে নিজে সদস্য হই। পরে ব্যবস্থাপক হয়ে আরও ৩০ জনকে ব্যবস্থাপক বানিয়েছি। এখন আলামিন ফরাজি টাকা নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছেন। আমার স্বামী ঝামেলা পছন্দ করেন না। তিনি হুমকি দিয়েছেন, এসব ঝামেলা মিটাতে না পারলে তালাক দেবেন।’
সদর উপজেলার গাগলাইল গ্রামের বাসিন্দা ও গুরুদয়াল কলেজের স্নাতক শ্রেণীর ছাত্রী নাঈমা সুলতানা বলেন, ‘পড়াশোনার পাশাপাশি কিছু আয় হবে ভেবে সদস্য হয়ে ব্যবস্থাপক হয়েছিলাম। প্রতি মাসে এক হাজার ২৪০ টাকা বেতন পাওয়ার কথা। এ টাকায় আমার পড়াশোনার খরচ চলত। এখন আলামিন ফরাজির প্রতারণায় আমার কলেজে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। সদস্যদের ভয়ে ঘর থেকে বের হতে পারি না।’
কটিয়াদী উপজেলার করগাঁও গ্রামের আরেকজন ব্যবস্থাপক লক্ষ্মী রানী সরকার (২৩)। তিনি জানান, সদস্যদের চাপ ও হুমকির মুখে বাড়ি ছেড়ে শহরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।
নিকলীর সিংপুর গ্রামের ব্যবস্থাপক সুমাইয়া আক্তার জানান, জমি বিক্রি করে সদস্যদের টাকা ফেরত দিতে হবে। তা না হলে গ্রাম ছাড়তে হবে।
কথা বলার জন্য আলামিন ফরাজির বাড়িতে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তাঁর ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
সমাজসেবা অধিদপ্তর কিশোরগঞ্জের উপপরিচালক আজাহার আলী মিঞা প্রথম আলোকে জানান, মডেল ডিজিটাল বাংলাদেশ নামে কোনো সমবায় প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন আছে বলে তাঁর জানা নেই।

No comments

Powered by Blogger.