নগর দর্পণ: চট্টগ্রাম-কেউ পেটাচ্ছেন, কেউ ধমকাচ্ছেন by বিশ্বজিৎ চৌধুরী

ক্ষমতার কাছাকাছি থাকলে আশপাশের লোকজনকে বড় তুচ্ছ মনে হয়। কতটা তুচ্ছ যে মনে হয়, তা বুঝতে খুব বেশি গবেষণার প্রয়োজন নেই। শুধু একজন সাংসদ আবদুর রহমান বদির গত কয়েক বছরের কর্মকৃতি (?) খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে ক্ষমতার উত্তাপ মানুষকে কতটা উদ্ধত ও উত্তেজিত করে, কতটা পরিণাম-বিবেচনার ঊর্ধ্বে নিয়ে যায়।
উখিয়া-টেকনাফ এলাকা থেকে নির্বাচিত সরকারদলীয় এই সাংসদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন নির্বাচনে দায়িত্ব পালনরত ভ্রাম্যমাণ ম্যাজিস্ট্রেট, সড়ক ও জনপথ বিভাগের জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, স্কুলশিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধা, পুলিশ, আইনজীবী, ঠিকাদার, ব্যবসায়ীসহ অনেকে। এঁদের সবাইকে নানা সময়ে নিজের হাতে পিটিয়েছেন তিনি।
কক্সবাজার আদালতে সাংসদ বদি একবার হাজিরা দিতে গেলে এক নির্বোধ (?) পুলিশ কনস্টেবল নিয়ম অনুযায়ী হাঁক দিয়েছিলেন—‘আসামি আবদুর রহমান হাজির...’। আর যায় কোথায়, আদালত ভবনেই তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে চড়-থাপড় মেরে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তুই আবদুর রহমানকে চিনিস না?’
সমস্যাটা এখানেই। বিত্তবৈভব তো বদির আগে থেকেই ছিল—নির্বাচন করেছেন অর্থের পাশাপাশি নিজের ক্ষমতা ও প্রভাব প্রমাণ করতে। নির্বাচিত হয়েছেন, এখন যদি ম্যাজিস্ট্রেট, ইউএনও, বন কর্মকর্তা বা সামান্য (?) স্কুলশিক্ষক বা পুলিশ কনস্টেবল সেই ক্ষমতার মর্যাদা উপলব্ধি করতে না পারেন, তাঁকে তো বুঝিয়ে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাহুবলের প্রদর্শনের চেয়ে উত্তম ব্যবস্থা আর কী হতে পারে?
এর আগে চট্টগ্রামের ডবলমুরিং-বন্দর আসন থেকে নির্বাচিত সাংসদ এম এ লতিফের বীরত্বও দেখেছিলাম আমরা। বিমানযাত্রায় পাশাপাশি আসনে বসা একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেছিলেন তিনি। বন্দর পরিচালনা পরিষদের একজন সদস্যের ওপর কীভাবে চড়াও হয়েছিলেন লতিফ, সেই ছবিও ছাপা হয়েছে পত্রপত্রিকায়। পরে অবশ্য দলীয় কোন্দলের কারণে কর্মীদের হাতে হেনস্তা হয়ে মাটিতে গড়াগড়ি যেতেও দেখেছি তাঁকে, ফটো সাংবাদিকদের কল্যাণে। রাজনীতি করতে গেলে এ রকম এক-আধটু হয়, ক্ষমতার দাপট তাতে কমে না।
এসব আস্ফাালনকে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা কীভাবে নিয়েছিলেন, আমরা জানি না, তাঁদের কাছে কোনো সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছিল কি না, তা-ও জানা নেই। তবে এসব ঘটনা সাধারণ মানুষ বা সচেতন মহলকে যতই উদ্বিগ্ন করুক, সরকারি দলের বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীদের মধ্যে যে উৎসাহ ও প্রেরণা (?) সঞ্চার করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দেশের বিভিন্ন স্থানে বারবার এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি সে কথাই মনে করিয়ে দেয়।
১২ আগস্ট প্রথম আলো পড়ে নতুন একজনের সঙ্গে পরিচয় হলো। তিনি গাংনী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও পৌরসভার নির্বাচিত মেয়র। জানা গেল, সাধারণ নাগরিক, সরকারি চাকরিজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ব্যাংক কর্মকর্তাসহ অনেকেই প্রহূত হয়েছেন তাঁর হাতে। তাঁর ভাষায় এটা ‘অন্যায়ের প্রতিবাদ’। দৃঢ়তার সঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘মানুষ আমাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে। এটা আমি করেই যাব।’ অর্থাৎ, নির্বাচিত হলে আইন তাঁর হাতে, তিনি নিজে আইনের ঊর্ধ্বে।
গত ৭ আগস্ট প্রথম আলোতে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলায় এক আওয়ামী লীগ দলীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং তাঁর সমর্থকেরা বন বিভাগের দুজন কর্মকর্তাকে পিটিয়ে আহত করেছেন। তাঁদের অপরাধ, ট্রেনে কাটাপড়া বিট কার্যালয়ের এক মালীর মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করতে গিয়েছিলেন তাঁরা। বন কর্মকর্তারা তাঁর অনুমতি না নিয়ে কেন তাঁর এলাকায় তদন্ত করতে এসেছেন এ কথা জানতে চেয়ে ভারপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তার (ওসি) সামনেই তাঁদের পেটাতে শুরু করেন ইউপি চেয়ারম্যান জাহেদ ইকবাল ও তাঁর সমর্থকেরা। মারতে মারতে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় খইয়াছড়া ইউপি কার্যালয়ে। সেখানে নিয়ে গিয়েও পেটানো হয় তাঁদের। এ সময় চিৎকার করে চেয়ারম্যান বলতে থাকেন, ‘আমার অনুমতি না নিয়ে কিসের তদন্ত?’ পুলিশ কনস্টেবলকে পিটিয়ে সাংসদ বলেছিলেন, ‘আমাকে তুই চিনিস না?’ এখানে যেন সেই কথারই প্রতিধ্বনি করলেন ইউপি চেয়ারম্যান। সবাই যার যেটুকু ক্ষমতা তা প্রদর্শনের ব্যাপারে আপসহীন!
একই দিনের (৭ আগস্ট) প্রথম আলোতে প্রকাশিত আরেকটি সংবাদে জানা গেল, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবের সামনে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন আবু তৈয়বকে গালাগাল করেছেন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) নেতা ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি শেখ শফিউল আজম। সিভিল সার্জনের অপরাধ, তিনি অননুমোদিত অনুপস্থিতির জন্য ১৬ জন চিকিৎসকের কাছে কৈফিয়ত তলব করেছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবের সঙ্গে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের নবনির্মিত একাডেমিক ভবন পরিদর্শনে গিয়েছিলেন সিভিল সার্জন। সেখানে উপস্থিত হয়ে স্বাচিপের নেতা সবার সামনে সিভিল সার্জনকে গালাগাল করেন এবং হাসপাতাল এলাকা থেকে বেরিয়ে যেতে নির্দেশ দেন। স্বাচিপ নেতার ক্ষমতা নিশ্চয়ই সিভিল সার্জন জানেন, কিন্তু অননুমোদিত অনুপস্থিতির জন্য কৈফিয়ত তলবের মতো রুটিন কাজেও যে তাঁর অনুমতি লাগবে, তা হয়তো জানতেন না। সেই অজ্ঞতার খেসারত তাঁকে দিতে হলো। গত জোট সরকারের আমলে ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) নেতা এবং বিএমএর কেন্দ্রীয় মহাসচিব জাহিদ হোসেনের দাপট আমরা দেখেছি। চিকিৎসকদের নিয়োগ-বদলি ইত্যাদি কোনো কিছুই তাঁর অঙ্গুলি হেলন ছাড়া হয়নি তখন। ন্যায়-অন্যায় তুচ্ছ, সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পাওয়া চিকিৎসকদের ভাগ্য ছিল তাঁর হাতে। জোট সরকার ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়ার পর বেরিয়ে এসেছে তাঁর অনেক দুর্নীতির তথ্যও। ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে শুধু। দেশের হাজার হাজার চিকিৎসকের অবস্থা আগের মতোই করুণ, যাঁরা ড্যাব নন, স্বাচিপও নন।
দল ক্ষমতাসীন থাকলে আইনের স্পর্শ থেকে দূরে থাকা যাবে—এমন কোনো বার্তা কি পৌঁছে গেছে সর্বস্তরে? তা না হলে অস্ত্র মামলার আসামি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী কেন চড়াও হলেন প্রক্টরের ওপর? পুলিশ কেন মামলা করল বা সেই মামলায় চার্জশিট দেওয়া হলো কেন তার কৈফিয়ত দেওয়া প্রক্টরের দায়িত্ব? এমনকি দু-দুবার বহিষ্কৃত একজন ছাত্র তাঁকে পরীক্ষায় বসার অনুমতি দিতেও জোরাজুরি করেছেন প্রক্টরকে। গত ছয় মাসে চারবার শিক্ষকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। এর মধ্যে অন্তত তিনবার এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এর একটি ঘটনারও বিচার হয়নি। প্রক্টর বলেছেন, ‘শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করার জন্য আমরা কিছু প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণ করি। কিন্তু কিছু ছাত্রসংগঠনের আচরণ দেখে মনে হয়, আমরা তাদের আজ্ঞাবহ।’ এই হতাশা ও ক্ষোভের অনুরণন আজ সারা দেশে অনেক শিক্ষকের মধ্যেই। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ছাত্রলীগ। টেন্ডার-চাঁদাবাজি-দলাদলি থেকে শুরু করে হেন কোনো কাজ নেই, তারা করেনি। বিরক্ত হয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কছেদ করেছিলেন ছাত্রলীগের সঙ্গে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ দলের ভেতর শিবিরের চর ঢুকে গেছে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না।
সম্প্রতি সুশৃঙ্খল পরিবেশে ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে ছাত্রলীগের সাবেক অনেক নেতাই ছাত্রনেতা ও কর্মীদের আচরণ শোধরাতে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। কিন্তু ফল কি কিছু হলো? হলে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কেন রোষানলের শিকার হলেন ছাত্রলীগের কর্মীদের?
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.