ধর্ম-আর্তমানবতার সেবায় ইসলাম by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

ইসলামে সৃষ্টির সেবা ও জনকল্যাণের প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। বিশ্বজগতের অসংখ্য সৃষ্টির মধ্যে মানুষই প্রধান। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব তথা ‘আশরাফুল মাখলুকাত’। তাই মানুষের সেবা করাই মানুষের প্রধান কাজ। বিশেষ করে, অসহায়, দুর্বল, গরিব-দুস্থ ও আর্তমানবতার সেবা করা একান্ত আবশ্যক। আর জীবজন্তু, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ,


গাছপালা প্রভৃতি অন্যান্য সৃষ্টিজীবকে মানবজাতির উপকারের জন্য তাদের অনুগত করে আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি করেছেন। তাই মানুষ আল্লাহর সব সৃষ্টির প্রতি দয়া-মায়া ও সাহায্য-সহানুভূতি প্রদর্শন করবে—এটাই স্বাভাবিক। ইসলামের পরিভাষায় আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি সহানুভূতি, আদর-যত্ন ও সেবা-শুশ্রূষা করার নামই ‘খিদমতে খাল্ক’। যারা সৃষ্টির প্রতি দয়া প্রদর্শন করে, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তাদের ওপর রহমত বর্ষণ করেন। নবী করিম (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘তোমরা পৃথিবীবাসীর প্রতি দয়া করো, তাহলে যিনি আসমানে আছেন, তিনি (আল্লাহ) তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।’ (তিরমিজি)
আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগির পর মানুষের প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে আর্তমানবতার সেবা, জনকল্যাণ ও অন্যান্য সৃষ্টিজীবের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করা। যে হূদয় অন্যের ব্যথা বোঝে না, যে মানুষ অন্যের প্রতি দয়া করে না, সে কখনো অন্যের কাছ থেকে দয়া পাওয়ার আশা করতে পারে না। রুগ্ণ লোকের সেবা-যত্ন করা, ক্ষুধার্তকে অন্নদান করা, বস্ত্রহীনকে বস্ত্রদান করা, নিরাশ্রয়কে আশ্রয়দান করা, বিদ্যাহীনকে বিদ্যা শিক্ষা দেওয়া, বিপথগামীকে সৎপথ প্রদর্শন প্রভৃতি জনসেবা ও মানবকল্যাণমূলক কাজ ইসলামের পরিভাষায় খিদমতে খালেকর অন্তর্ভুক্ত।
মহানবী (সা.) আর্তমানবতার সেবা ও জনকল্যাণে উৎসাহ প্রদান করে নির্দেশ দিয়েছেন, ‘তোমরা ক্ষুধার্তকে খাদ্য দাও, অসুস্থ ব্যক্তির খোঁজখবর রাখো (সেবা করো), বন্দীকে মুক্ত করে দাও এবং ঋণের দায়ে আবদ্ধ ব্যক্তিকে ঋণমুক্ত করো।’ (বুখারি) রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, ‘যার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাতযাপন করে, সে আমার ওপর ঈমান আনেনি।’ (মুসনাদে দাইলামি)
একজন মুমিন মুসলমানের পরিচয় তুলে ধরে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন, ‘আর তারা তাঁর (আল্লাহর) মহব্বতে দরিদ্র, এতিম ও বন্দীকে খাদ্যদান করে।’ (সূরা আদ-দাহর, আয়াত-৮) একজন মুসলমান অপর মুসলমানের উপকার করলে আল্লাহ তাকে জান্নাতের মধ্যে অশেষ শান্তিতে রাখবেন। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যেকোনো মুসলমান অন্য বস্ত্রহীন মুসলমানকে কাপড় দান করলে আল্লাহ তাকে জান্নাতের মধ্যে সবুজ বর্ণের পোশাক দান করবেন, কোনো মুসলমান অন্য মুসলমানকে ক্ষুধার্ত অবস্থায় খাদ্য দান করলে আল্লাহ তাকে জান্নাতের সুস্বাদু ফল খাওয়াবেন এবং কোনো মুসলমান অন্য মুসলমানকে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় পানি পান করালে আল্লাহ তাকে সিলমোহরকৃত পাত্র থেকে পবিত্র পানীয় পান করাবেন।’ (আবু দাউদ)
ইসলামে আর্তমানবতার সেবা ও জনকল্যাণের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোকপাত করে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতিফল ঘোষণা করে বলেছেন, ‘তোমার ভাইয়ের প্রতি তোমার হাসিমুখে তাকানো হলো একটি সাদকা, কাউকে ভালো কাজ করার জন্য তোমার উপদেশাবলি হলো একটি সাদকা, কাউকে মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখাও একটি সাদকা, পৃথিবীতে পথভ্রষ্ট ব্যক্তিকে তোমার সুপথ প্রদর্শনও তোমার জন্য একটি সাদকা, যে ব্যক্তি চোখে কম দেখে তাকে সাহায্য করাও একটি সাদকা, যদি রাস্তা থেকে পাথর, কাঁটা এবং হাড় সরিয়ে দাও, এটাও তোমার জন্য একটি সাদকা, আর তোমার বালতির পানি দিয়ে তোমার ভাইয়ের বালতি ভরে দেওয়াও একটি সাদকা।’ (তিরমিজি)
অসহায় ও দুস্থ মানুষকে সাহায্য-সহায়তা করা যেমন মানুষের অবশ্যকর্তব্য; তেমনি সব সৃষ্টিজীব পশুপাখি, গাছপালা, বৃক্ষলতা, কীটপতঙ্গ এবং পরিবেশের প্রতিও মানুষের অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে। এদের লালন-পালন, রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও মানুষের। সৃষ্টির প্রতি সদয় ব্যবহার করলে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন খুশি হন, আর সৃষ্টির প্রতি অবহেলা বা নিষ্ঠুর আচরণ করলে তিনি অসন্তুষ্ট হন। এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহর পরিজন; সুতরাং আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তিই প্রিয়, যে তার পরিজনের প্রতি বেশি অনুগ্রহশীল।’ (মিশকাত)
রাসুলুল্লাহ (সা.) সমগ্র জীবনব্যাপী আর্তমানবতার সেবা ও জনকল্যাণ করে গেছেন। তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষের সুখ-দুঃখের খোঁজখবর নিতেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পর মসজিদে সাহাবিদের দিকে ঘুরে বসে সবার খোঁজখবর নিতেন, কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন, কারও অসুবিধা থাকলে তা দূর করার চেষ্টা করতেন। নবীজি সব সময় রোগীর সেবা করতেন। অসুস্থ রোগী বিধর্মী বা ভীষণ শত্রু হলেও তার সেবা করতে দ্বিধাবোধ করতেন না।
সুতরাং, একজন মানুষ অন্যকে সর্বাবস্থায় সাহায্য করবে। মনে করতে হবে, যেন সব মুসলমান একটি মানবদেহের মতো। দেহের যেকোনো স্থানে আঘাত লাগলে যেমন সমস্ত শরীরে ব্যথা অনুভূত হয়, তেমনি একজন মুসলমানের দুঃখে সব মুসলমান দুঃখিত হবে এবং তাকে সাহায্য করে দুঃখ মোচন করবে। এ মর্মে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘মুমিনগণও একটি মানবদেহের মতো, চক্ষু পীড়িত হলে যেমন সমস্ত দেহ পীড়িত হয়, মস্তিষ্ক পীড়িত হলে যেমন সারা দেহ পীড়িত হয়, অর্থাৎ একজন মুমিন বিপদে পড়লে সবাই তার বিপদে এগিয়ে আসবে এবং তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করবে। যে ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে সাহায্য করে ও জনকল্যাণে এগিয়ে আসে, আল্লাহ তাকে সাহায্য করে থাকেন। আর যে ব্যক্তি এতিম ও অসহায় লোকদের সাহায্য করে না, প্রকৃতপক্ষে সে ঈমানদার নয়।’
ইসলাম সৃষ্টির সেবা, জনকল্যাণ ও মানবসমাজের উপকারের জন্য নিজের যথাসর্বস্ব বিলিয়ে দিতে উদ্বুদ্ধ করে, যাতে সমাজজীবন থেকে অশান্তি ও অবজ্ঞা বিদূরিত হয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলাম শুধু মানুষের সেবা ও জনকল্যাণের প্রতিই উদ্বুদ্ধ করে না, বরং আল্লাহর সব সৃষ্টির প্রতি সেবাদানের ব্যাপারে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে। এমনিভাবে পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে ইসলামের দৃষ্টিতে আর্তমানবতার সেবা ও জনকল্যাণের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী সমাজের বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের মধ্যে সাহায্য-সহযোগিতার ফলে পারস্পরিক আন্তরিকতা, স্নেহ, মায়া-মমতা, শ্রদ্ধা-ভক্তি, ভালোবাসা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিশ্চিতভাবে গড়ে উঠতে পারে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.