তারুণ্যের সঙ্গে চলুক স্বদেশ by বদরুন নাহার

শুধু বর্তমানেই ডুবে থাকি না বলে আমরা হতাশ নই। আমাদের মনে থাকে ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনার বিষয়। আমরা বিশ্লেষণ করি স্বাধীনতার এত বছর পরও মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়নের বিষয়টি। যে যুদ্ধে রয়েছে রাজনৈতিক নেতৃত্বের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আর ছাত্র-শিক্ষক থেকে কৃষক-শ্রমিকের সক্রিয় অংশগ্রহণ।


যে রিকশাওয়ালাটি যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে, সে স্বাধীন দেশে রিকশা চালাতেই পারে। কিন্তু সে যদি সেই কাজে অক্ষম হয়ে থাকে তাহলে রাষ্ট্র তার পুনর্বাসনের দায় এড়াতে পারে না। স্বাধীন দেশে একজন মুক্তিযোদ্ধার রিকশা চালানোতে আমাদের সম্মান যাবে না, কারণ সেটা তার পেশা। আমরা তার পেশার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু যখন একজন যুদ্ধাপরাধী দেশের সরকারের অংশ হয়ে যায়, তখন আমাদের স্বাধীনতার অবমাননা করা হয়


বাংলাদেশ স্বাধীনতাপ্রাপ্তির মাত্র চলি্লশ পেরিয়েছে। একটি দেশের সার্বিক বিবেচনায় এ সময়ের হিসাব খুব দীর্ঘকাল নয় তা যেমন সত্য, তেমনি সত্য হচ্ছে সময়কে সচেতনভাবে ব্যবহার না করতে জানলে পরবর্তীকালে সময় ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। ব্যক্তিমানুষের তারুণ্যের বয়সকাল হিসাবের সঙ্গে একটি রাষ্ট্রের বয়সকালের হিসাব এক কাতারে ভাবাটা কি ঠিক হবে? আমরা ভাবতে চাইছি, দেশটা এখনও তরুণ। সেই অর্থে এখনই প্রকৃত সময় দেশের গণতন্ত্র সুসংহত করার। আধমরাদের ঘা মেরে বাঁচানোর প্রয়াসে রয়েছে এই সময়ের তরুণরা। নিজেদের এই আশাবাদী অবস্থানে দেখতে পারি আমরা স্বাধীন বলেই। স্বাধীনতা আমাদের সবচেয়ে বড় মানসিক শক্তি। এই বোধের পরিচর্যা তরুণরা অনবরত করে যাচ্ছে_ সে বিশ্বাস তাদের যেমন আছে, তেমনি সমগ্র দেশবাসীরও রয়েছে। ইতিহাস ঘেঁটেও সেই তারুণ্যের স্বাধিকার বোধের সন্ধান মেলে।
যারা পরাধীনতা থেকে স্বাধীনতা পেয়েছেন সেসব মানুষের মননে স্বাধীনতার তাৎপর্য আর এ সময়ের তরুণদের কাছে স্বাধীনতার তাৎপর্য হুবহু একই হবে ভেবে নেওয়াটা ঠিক নয়। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার মর্ম তারা কোনো অংশে কম উপলব্ধি করছে তা ভাবার অবকাশ নেই। তারুণ্য খুব সহজে হতাশ হওয়ার নয়। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের কাছে; আমাদের বলতে যারা স্বাধীনতা অর্জনের পরে জন্মেছে তাদের কাছে পাঠ্যবই, গল্প, নাটক এবং প্রত্যক্ষ যোদ্ধার কাছ থেকে শোনা বিষয়। সংবাদপত্রের খবর নানাভাবে ইতিহাস হয়ে এসেছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ভিন্ন ভিন্ন দলীয় সময়কালে ইতিহাসের বারবার পরিবর্তনের ফলে এক ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হওয়াটা খুব স্বাভাবিক ছিল। তার মানে এই নয় যে, আমরা সবসময় বিভ্রান্ত হয়ে থাকব। আমাদের সচেতন বেড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে সে বিভ্রান্তির অবসানও ঘটে। এ বিষয়ে মাত্র দু'দিন আগে শেষ হওয়া অমর একুশে গ্রন্থমেলার কথায় ধরা যাক, যেখানে সবচেয়ে বেশি উপস্থিতি ছিল তরুণদের। বিষয়টি কি সচেতনতার লক্ষণ নয়? আর আমাদের মাঝে কোনো ডরিমন বিভ্রান্তির অবকাশ নেই। তরুণরা ঠিকই সঠিক বইটি সংগ্রহ করে নেয়। এটা তাদের স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতার ব্যবহার তরুণরা নানা সময় নানাভাবে করে থাকে। সে সঙ্গে স্বাধীনতার প্রতিটি সংগ্রামী মানুষের প্রতি স্বাধীন দেশে জন্ম নেওয়া তরুণের রয়েছে শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা। স্বাধীনতা রক্ষার বিষয়টির প্রতি সজাগ থাকার মাঝেই তার প্রকাশ ঘটায় তারা। একটি ভূখণ্ড পেয়ে পতাকা ওড়াতে পারাটাই স্বাধীনতার শেষ কথা নয়। আমাদের স্বাধীনতা আমাদেরই রক্ষা করতে হবে_ এই মন্ত্র প্রতিটি তরুণের মধ্যেই রয়েছে। 'স্বাধীনতা মানে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার', সেই অবাধ সাঁতারের পরিবেশ যদি বিঘি্নত হয় সেখানে আপস করে না তরুণ প্রজন্ম। বিয়ের আসর থেকে যৌতুকলোভী স্বামীকে তালাক দিয়ে সে তার স্বাধীনতাকে রক্ষা করে। প্রমাণ করে, শুধু আইন প্রণয়ন করেই সব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সচেতনতাই সমাধানের পথ সুগম করে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক নিয়মেই আমাদের নানা অগ্রগতি হয়েছে, যা একটি স্বাধীন দেশের স্বাভাবিক কাম্য। কিন্তু যতটা হতে পারত ততটা কি হয়েছে? আমাদের দেশের সাধারণ মানুষজন স্বাধীনতা চেয়েছিল বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থা থেকে মুক্তি পেতে। সেই অর্জনের পথে বারবার বাধা এসেছে। স্বাধীনতা পাওয়ার পরও এ দেশে অবৈধভাবে সামরিক শাসক ক্ষমতায় থেকেছে। কিন্তু সাধারণ জনগণ সবসময়ই চেয়েছে রাজনৈতিক সরকার এবং গণতান্ত্রিক উপায়ে তার গঠন। সেই সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক শাসনের পক্ষে তরুণ। যদিও আমরা দেখি রাজনৈতিক সরকারগুলোও দলীয় স্বার্থের প্রতি বেশি মনোযোগী হয়ে পড়ে। ফলে স্বাধীন দেশেও যোগ্য নেতৃত্বের সংকট তৈরি হয়। যে দল সরকার গঠন করে তারা তাদের আসন অক্ষুণ্ন রাখার প্রতিযোগিতায় মত্ত হয় যে কোনো উপায়ে। অন্যদিকে বিরোধী দল সরকারের পতন ঘটিয়ে আসন গ্রহণ করতে উদ্ধত হয়ে পড়ে। প্রকৃত অর্থে জনমানুষের সার্বিক উন্নয়নের প্রসঙ্গ এখানে উপেক্ষিত হয়। জনগণ তবুও অবিচল, তারা চায় রাজনৈতিক সুষ্ঠুতার মাধ্যমে দেশ চলুক। তারা তাদের স্বাধীন ভোটাধিকারের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তাই তারা এক দল ছেড়ে অন্য দলে ভোট দেয় এবং প্রত্যাশায় থাকে দেশের ভালোর জন্য। এরূপ পরিস্থিতিতে এ কথা সত্য যে, জনগণ চায় সুষ্ঠু রাজনৈতিক প্রচেষ্টা। কিন্তু দলীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ক্রমশ পুঁজিবাদী শ্রেণীর হাতিয়ারে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। আর সে কারণেই বুঝি আমাদের চলি্লশজন স্কুলছাত্রের মৃত্যুর প্রতিবাদে রাজনৈতিক দল পথে নামে না। দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধিতে দেশের আপামর জনগোষ্ঠীর যখন নাভিশ্বাস অবস্থা, তখন আমাদের রাজনীতি চলে সংসদের সারিবদ্ধ আসনের বণ্টন নিয়ে। আমাদের শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন, উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের সুনির্দিষ্ট নীতিনির্ধারণ বিষয়ে রাজনৈতিক নেতাদের শক্ত অবস্থান নিতে দেখি না। অথচ আমাদের তরুণদের মেধার কোনো ঘাটতি নেই, রয়েছে বিকাশের স্থান সংকট। আমাদের তরুণরা মেধাবী এবং পরিশ্রমী বলেই আজ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের অন্যতম আয়োজক হতে পারে বাংলাদেশ। আমাদের রাজনীতিবিদরা পড়শিসুলভ ক্ষুদ্র বিষয়ে কোমর বেঁধে নেমে যান ঝগড়া করতে। অথচ আমরা চাই তারা দেশের বৃহৎ স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে যৌক্তিক যুক্তিতর্কের মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হোক; রাজনীতির কারণে জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ের কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি যেন না হয়। এভাবেই আমরা স্বাধীনতা খুঁজে ফিরি সমাজ-রাষ্ট্রের যাপিত জীবনে।
শুধু বর্তমানেই ডুবে থাকি না বলে আমরা হতাশ নই। আমাদের মনে থাকে ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনার বিষয়। আমরা বিশ্লেষণ করি স্বাধীনতার এত বছর পরও মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়নের বিষয়টি। যে যুদ্ধে রয়েছে রাজনৈতিক নেতৃত্বের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আর ছাত্র-শিক্ষক থেকে কৃষক-শ্রমিকের সক্রিয় অংশগ্রহণ। যে রিকশাওয়ালাটি যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে, সে স্বাধীন দেশে রিকশা চালাতেই পারে। কিন্তু সে যদি সেই কাজে অক্ষম হয়ে থাকে তাহলে রাষ্ট্র তার পুনর্বাসনের দায় এড়াতে পারে না। স্বাধীন দেশে একজন মুক্তিযোদ্ধার রিকশা চালানোতে আমাদের সম্মান যাবে না, কারণ সেটা তার পেশা। আমরা তার পেশার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু যখন একজন যুদ্ধাপরাধী দেশের সরকারের অংশ হয়ে যায়, তখন আমাদের স্বাধীনতার অবমাননা করা হয়। এভাবে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতার প্রতি অশ্রদ্ধা পোষণই শুধু করছি না, ধীরে ধীরে অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার পরিবেশ সৃষ্টি করছি। এর ফলে মৌলবাদী সম্প্রদায়ের সম্প্রসারণ যেমন ঘটে, তেমনি বিদেশি শক্তিগুলো ক্রমশ আমাদের পরামর্শক হয়ে উঠছে। এ বিষয়গুলোকে তরুণরা খুবই গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে।
আজ তরুণদের সমর্থন নিয়েই দেশের সরকার গঠন সম্ভব হচ্ছে। শুরু করা সম্ভব হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। আর এই বিচার প্রক্রিয়াও সফল হবে, কারণ তরুণরা সজাগ রয়েছে। তারা স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এসব তরুণ আইনি পরিচ্ছদের চেয়ে বাস্তবায়নের প্রতি আগ্রহী। মুক্তচিন্তা আর সচেতনতাই তাদের কর্মকাণ্ডের নেপথ্যে কাজ করে। তরুণদের ওপর কিছু চাপিয়ে দেওয়া যায় না, স্রোতের মধ্যে তারা পলি খুঁজে নেবেই। সবকিছুই ঘটবে সাবলীল, কিন্তু তা নতুন কিছুই হবে। এই বোধের কারণেই স্বাধীনতার বয়স চলি্লশ পেরোলেও কোনো সম্ভাবনার দুয়ার বন্ধ নয়। তার প্রতি দায়বদ্ধ হয়ে উঠেছে তরুণ সমাজ। তরুণরা কখনোই ভুলে যায় না_ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়। তাই বলা যায় কোনো উদ্ভট উটের পিঠে নয়, তরুণ্যের সঙ্গে চলবে স্বদেশ।
সুতরাং আমাদের চলি্লশ বছরের ইতিহাসে হতাশ হওয়ার অবকাশ নেই। আমাদের স্বাধীন দেশ রয়েছে, বিশাল শ্রমশক্তি রয়েছে। আমাদের কিছুই ফুরিয়ে যায়নি, দরকার সঠিক সমন্বয়ের। সম্ভাবনাময় তরুণদের উদ্যোগী কর্মপ্রয়াসে তারুণ্যের সঙ্গেই পথ চলবে স্বদেশ। আমাদের স্বাধীনতাই আমাদের সেই সাহস দিয়েছে।

স বদরুন নাহার :গল্পকার

No comments

Powered by Blogger.