মূলধারা বলে আর কিছু থাকবে না-সাহিত্যের আদৌ পাঠক থাকবে? by হাসান আজিজুল হক

বহুকাল থেকে নিরক্ষরতার ব্যাপারটা একটা প্রধান বিঘ্ন হয়ে আসছে। সে জন্য মুদ্রিত অক্ষরের সঙ্গে যোগাযোগটাই তো চিরকাল কম। সাহিত্য বলে নয়, যেকোনো জিনিসেরই পাঠক কম। তার পরও কথা হচ্ছে মুদ্রিত অক্ষরের সঙ্গে যোগাযোগ যার আছে বা অক্ষর যে চেনে, তার পক্ষে সাহিত্যপাঠক হওয়া সম্ভব নয়।


এমনকি খবরের কাগজও, যে সাক্ষর সেও তা পড়তে পারে, তা নয়। যে নাম সই করে তাকে সাক্ষর বলে। তার একটা যোগ্যতার ব্যাপার আছে। আর সাহিত্য, এটিও কোনো বিষয় তো দাবি করে। সময় দাবি করবে—মনোযোগ, বুদ্ধি, চিন্তা ইত্যাদি দাবি করবেই। এখন এগুলো যদি কারো ঘট শূন্য হয় তাহলে সাহিত্য ক্রমেই তার কাছে অপাঠ্য বিষয় হবে। অর্থাৎ জায়গা নেবে কী, যেগুলো তথাকথিত সাহিত্য বলে চলে। সেগুলোর নাম করার দরকার নেই, তাদের পাঠক আছে। যেমন কেউ যদি যৌনরস দিয়ে সাহিত্য রচনা করে, তার পাঠক একটু বেশি হবে। তরুণ-তরুণীর প্রেম নিয়ে সাহিত্য করলে তার পাঠকও বেশি হবে। আর সাধারণভাবে সাহিত্য মানুষ যে কারণে পড়ত, তার একটা হচ্ছে সময় কাটানো, বিনোদন এবং নিজেকে সমৃদ্ধ করা। আজকে আমরা দেখতে পাচ্ছি সংস্কৃতির নতুন মাধ্যমগুলো বের হওয়ার ফলে আমার পছন্দ হোক বা না হোক, আমার এতটাই মনোযোগ অধিকার করে থাকে—সাহিত্য কেন, মানুষ অন্য নিত্যক্রিয়াগুলোও করতে পারছে না। আমি ঢাকা শহরের একটা শিশুর কথা ভাবি, তার সারা দিনের একটা রোজনামচা যদি রচনা করা হয়, দেখা যাবে, সে যখন বড় হবে তার সাহিত্য পড়ার ইচ্ছে হবে কি হবে না। তার সুকুমার কোনো বৃত্তি থাকবে কি থাকবে না। স্বাস্থ্য ভালো হবে না মন্দ। একদম লিখে দেওয়া যায়—গড় আয়ু বাড়বে, মানুষের মৃত্যুও বাড়বে। গাদা গাদা ওষুধ খাবে—আমেরিকায় যা হচ্ছে আর কি। আমাদের এখানেও সেসব হবে। কাজেই এই যে অবস্থাটা—তা যদি বিবেচনা করি তাহলে আর খুঁজতে অসুবিধা হয় না, কেন মূলধারার পাঠক কমে যাচ্ছে। সাহিত্যের পাঠক কমে যাচ্ছে। আমি তো সন্দেহ করি, এরপর আদৌ পাঠক থাকবে কি না। সাহিত্য পাঠকের কাছে কিছু ডিমান্ড করে। শরৎচন্দ্র যত লোক পড়ত রবীন্দ্রনাথ কিন্তু তত লোক পড়ত না। রবীন্দ্রসাহিত্য অনেক বেশি পাঠকের কাছে দাবি করে, শরৎচন্দ্রের কাছে সেই দাবিটা ছিল না। ফলে শরৎচন্দ্র বারবার বলতেন, রবিঠাকুরের লেখা আমাদের জন্য আর আমার লেখা তোমাদের জন্য। এই কথাটার কিন্তু মানে আছে। সে জন্য আমাদের এখানে দেখি, যতটা বিভূতিভূষণ পড়া হয়, ততটা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পড়া হয় না। মানিক আমাদের কাছে আরও অনেক বেশি দাবি করে। তারাশঙ্কর আরও কম পড়া হয়। সে আবার অনেকটা আঞ্চলিকতা দাবি করে। এগুলো অদ্ভুত ব্যাপার। পাঠক কমে যাওয়ার অজস্র কারণ আছে। মূল কারণ হচ্ছে, সমাজের বর্তমান যে ধাঁচটা এবং এই ধাঁচে সংস্কৃতির যে চেহারাটা, এই চেহারাতে মূলধারা বলে আর কোনো কিছু থাকবে না।

No comments

Powered by Blogger.