স্টুডিও-সমাজ-বাস্তবতার ছবি by নন্দিনী মুখার্জি

শুধু ক্যানভাস দেখেই বোঝা যাবে, রাতে আমি ছবি এঁকেছি; স্টুডিও এতটাই পরিচ্ছন্ন থাকে যে রং-ব্রাশ দেখে জানার উপায় নেই রাতে এখানে ছবি আঁকা হয়েছিল।’ শিল্পীদের প্রচলিত অগোছালো ধারার বাইরে আতিয়া ইসলাম এ্যানির শিল্পীজীবন। পরিপাটি, পরিচ্ছন্ন এবং গোছানো তাঁর স্টুডিও, ব্যক্তিজীবন ও শিল্পচেতনা।


সমাজের নানাবিধ ক্ষরণ তাঁকে পীড়িত করে। ক্যানভাসে ফুটে ওঠে সমাজ-বাস্তবতার বিবিধ সমালোচনা। দর্শকের সঙ্গে তুমুল বিতর্কে অবতীর্ণ হয় তাঁর কাজ। এ সময়ের সমাজসচেতন শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম আতিয়া ইসলাম এ্যানি।
ধানমন্ডির ৬ নম্বর রোডে শিল্পী আতিয়ার স্টুডিও। শিল্পিত পরিপাটি ছিমছাম গোছানো এই শিল্পীর ছবি আঁকার জায়গা। শিল্পী আতিয়া নিজের আবেগ-অনুভূতিকে প্রকাশ করেন তাঁর আত্তীকৃত শিল্পভাষায়।
শিল্পী এ্যানি বলেন, ‘প্রথম দিকে লেখা ও ছবি আঁকা দুটোতেই স্বতঃস্ফূর্ত ছিলাম। আসলে যে যা উপভোগ করে, তার সেটাই করা উচিত। ছোটবেলা থেকেই আমি ভীষণ স্বাধীনচেতা। কীভাবে এ বিষয়টা তৈরি হয়েছে, এর ব্যাখ্যা আমি দিতে হয়তো পারব না। আমার বড় বোনের (আনা ইসলাম) কারণেও হতে পারে। আমরা খুব কাছাকাছি ছিলাম, তাই সে আমার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তবে আমাদের এভাবে স্বাধীন-স্বতঃস্ফূর্ত-প্রতিবাদী মানসিকতা গড়ে ওঠার পেছনের কারণ সম্ভবত সময়।’
শৈশবে পশ্চিম পাকিস্তান আর কৈশোর থেকেই নতুন দেশ—এই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হয়েই বেড়ে ওঠা। মনোবলের দৃঢ়তা এগিয়ে যাওয়ার অসম্ভব প্রেরণা তাদের প্রজন্ম পেয়েছিল সময়ের বাড়তি উপহার হিসেবে। ‘এখন পেছনে তাকালে অবাক হই ছোটবেলায় কেন আমি এমন ছিলাম! পারিপার্শ্বিক অসংগতি, অন্যায় আমাকে কষ্ট তো দিতই, সবকিছুর প্রতিবাদও করেছি সামর্থ্য অনুযায়ী। পরিবারেও অনেক জটিলতা তৈরি হয়েছিল বাবার সঙ্গে। আবার বাবাই আমার ছবি আঁকা ও লেখালেখির ক্ষেত্রে অনুপ্রাণিত করতেন প্রতিনিয়ত। সে সময়ে কিশোর বাংলা পত্রিকার সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম।’ বললেন এ্যানি।
ছবি আঁকার ক্ষেত্রে গুছিয়ে শুরু করা হয়নি শিল্পী আতিয়া ইসলাম এ্যানির। বিষয় নির্বাচন, কম্পোজিশন, উপস্থাপন—এসব বিষয়ে খুব পরিকল্পিতভাবে কাজ করেননি তিনি। সাবলীল ও স্বাভাবিকভাবেই তাঁর ছবিতে চলে আসে সামাজিক সংকটের বিবিধ অবয়ব। এখানেই তাঁর মানস গঠনের পরিচয় বিধৃত। চাইলেও তাঁর পরিবেশ-প্রতিবেশকে ভুলে ফ্যান্টাসিতে অবগাহন করতে পারেননি তিনি। ক্যানভাসের ফাঁক গলে বের হয়ে থাকে ব্যক্তি, সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতির অবক্ষয়। তাঁর ক্যানভাস তাই প্রচলিত সুন্দরের ব্যাকরণকে তোয়াক্কা না করেই বিবৃত হয়। সমাজভাষ্যের পাঠ নিতে, নারীবাদের মৌলিক বিষয়াবলি আত্মস্থ করতে তাঁর কাজকে নিবিড় পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে।
এ্যানি বলেন, ‘খুব বুঝে, ভেবে ছবি আঁকা আমার ’৯০ পরবর্তী সময়ে। এ সময়ে আমি কাজ নিয়ে, এর বিষয়বস্তু নিয়ে অনেক ভেবেছি। কী আমার মধ্যে তাড়না তৈরি করে, কীভাবে উপস্থাপন করব তা ভেবেছি। এর পেছনের কারণ হিসেবে আমি বলতে পারি, রাজনৈতিকভাবে সে সময়টা আমরা ভীষণ অনিশ্চয়তায় ছিলাম, স্বৈরাচারী শাসকের দীর্ঘ শাসনব্যবস্থার পর আমরা নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। আমাদের শিল্পচর্চার সময়টা ছিল স্বৈরশাসনের জাঁতাকলে দুমড়ে যাওয়া, যা আমাদের মনের মধ্যে তীব্রভাবে আঁচড় কেটেছিল। খুব বাজে সময়ের মধ্য দিয়ে কাটছিল আমাদের জীবন। জনজীবনের দুর্ভোগ, দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে আমরা লেখাপড়া শেষ করেছি। চারদিকে গোলাগুলি চলছে, আর আমরা পরীক্ষা দিয়েছি। সে সময়টা সবাইকে না ভাবালেও আমরা কিছু ছেলেমেয়ে ভেবেছিলাম। তার ছাপ রয়েছে আমাদের শিল্পকর্মে। সবাই তো প্রতিদিন একই পথ দিয়ে হেঁটে যায়, সবাই দেখে, কিন্তু লক্ষ করে না।’ অবচেতনেই সময়ের প্রভাব থাকে। কেউ কেউ সচেতনভাবেই সময়ের উত্তাপকে ধারণ করেন। সমাজ-রাজনীতির জারণে সিক্ত প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলন দেখা যায় শিল্পে-সাহিত্যে। সত্তর ও আশির দশকে বেড়ে ওঠা শিল্প-সাহিত্যে তাই দুর্দান্ত উদ্যম চোখে পড়ে। বাংলায় সম্ভাবনা এবং অবক্ষয় দুইয়েরই ফেনিয়ে ওঠা প্রায় একই সময়ে। তাই এ দুটি মুখই প্রবল পরাক্রমে আমাদের সামনে বিরাজমান। আতিয়া ইসলাম এ্যানি আমাদের শুভবোধকে আরও শাণিত করে চলেছেন।
রাজনীতির ধর্মীয় চেহারা আবার মধ্যযুগীয় কায়দায় ফিরে আসতে চাইছে। যদিও মুখোশের ধরনটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এর সূচনাও স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে। এ্যানি বলেন, ‘একটা সময় সবই সহনশীল হয়ে গেল আমাদের জন্য। তবে ধর্ম আমাদের জীবনকে পরিবর্তন করেছে, যা নেতিবাচক দিকেই ক্রমশ ধাবিত করে চলেছে। এ বিষয় নিয়ে কাজ করেছি তা অনেক ভেবে নয়; পারিপার্শ্বিকতা এভাবে আমাকে বিনির্মাণ করে চলেছে।’ মেয়েদের অবদমিত করার জন্য ধর্ম কীভাবে ব্যবহূত হয়, এর কিছুটা ছাপ রয়েছে তাঁর প্রথম প্রদর্শনী ‘উইমেন অ্যান্ড সোসাইটি’তে। অন্য একটি প্রদর্শনী ‘কালবেলা’ শিরোনামে করেছেন। তিনি মূলত সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়েই ছবি আঁকেন। এই প্রদর্শনী ছিল বিডিআর হত্যাকাণ্ড, গুপ্তহত্যা এবং নারীর দহনবিষয়ক।
শিল্পীর জন্য স্টাইল একেবারেই জরুরি নয় বলে মনে করেন আতিয়া ইসলাম এ্যানি। কারণ, ছবি আঁকার বিষয়টিই গুরুত্বপূর্ণ। আর নিজস্বতা তৈরি হয় কাজ করার মধ্য দিয়েই। এখানে আরোপিত কোনো কিছুই বেশিক্ষণ টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
ঝাপি আর্ট স্কুল শিল্পী আতিয়ার স্বপ্নের ভুবন। তিনি গত ২০ বছরের বেশি সময় ধরে নানা বয়সের ছেলেমেয়েদের ছবি আঁকার আগ্রহকে শাণিত করে চলেছেন এই স্কুলের মাধ্যমে। ব্যবসায়িক চিন্তার বাইরে থেকে শুধুই ছবি আঁকা শেখানোর আনন্দ নিয়েই এই প্রতিষ্ঠানটি চালিয়ে যাচ্ছেন।

শিল্পী আতিয়া ইসলাম: তিনি ১৯৬২ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ড্রয়িং অ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগ থেকে ১৯৮২ সালে বিএফএ এবং ১৯৮৫ সালে এমএফএ শেষ করেন। তিনি বহু একক এবং যৌথ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি সানবিমস স্কুলে শিক্ষকতা করছেন।

No comments

Powered by Blogger.