সংবিধান সংশোধন-আদিবাসীদের ওপর চাপানো জাতীয়তাবাদ by রোবায়েত ফেরদৌস

ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতামুখী অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোকে বলতে চাই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এগিয়ে চলার জন্য এবং আদিবাসীদের সমস্যার স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধানের ক্ষেত্রে তাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিষয়টি আবারও নতুন করে ভাবুন।


বাংলাদেশ একটি বহু জাতির সম্মানজনক অংশীদারিত্বের রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত হওয়ার স্বপ্নকে ধারণ করতে সক্ষম হবে, এটাই প্রত্যাশা


আদিবাসীরা পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের দাবি করেছেন। তারা বলেছেন, তাদের ওপর জোর করে বাঙালি জাতীয়তাবাদ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, এটা তারা মানবেন না। বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যাক। নির্বাচনী ইশতেহার, আওয়ামী লীগ যাকে দিনবদলের সনদ আখ্যা দিয়েছিল, আদিবাসী বিষয়ে সেখানে যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা ছিল এরকম : 'সংখ্যালঘু, আদিবাসী, ক্ষুদ্র নৃ-জাতিগোষ্ঠী এবং দলিতদের প্রতি বৈষম্যমূলক সব ধরনের আইন ও অন্যান্য ব্যবস্থার অবসান করা হবে। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু এবং আদিবাসীদের চাকরি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। অনগ্রসর অঞ্চলগুলোর উন্নয়নে বর্ধিত উদ্যোগ, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, আদিবাসী ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের অধিকারের স্বীকৃতি এবং তাদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবনধারার স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণ ও তাদের সুষম উন্নয়নের জন্য অগ্রাধিকারভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে' (নির্বাচনী ইশতেহার, অনুচ্ছেদ ১৮.১ ও ১৮.২)
ইশতেহার-প্রতিশ্রুতির পরিপ্রেক্ষিতে খতিয়ে দেখা যাক, গত ৩০ জুন পাসকৃত পঞ্চদশ সংশোধনীতে আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি কতটা মিলল? সংবিধানের ৬(২) ধারায় যুক্ত হয়েছে, 'বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালী এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন।' এর মানে কী? এর মানে খুব সোজা_ এখন থেকে বাংলাদেশে বাঙালি ভিন্ন বসবাসরত অপরাপর জাতিগুলো যেমন হাজং, কোচ, বানাই, মারমা, চাকমা, গারো, সাঁওতাল, উঁরাও, মুণ্ডা, খাসিয়া, মণিপুরি, খুমি, খিয়াং, লুসাই, বম, ম্রো কিংবা রাজবংশীরা চিহ্নিত হবেন বাঙালি জাতি হিসেবে। এর মধ্য দিয়ে আবারও ১৯৭২-এর সংবিধানের সেই ঐতিহাসিক ভুলেরই পুনরাবৃত্তি করা হলো। ক্ষমতাসীন দলকে এই সত্য কে বোঝাবে যে, বাংলাদেশের চারদিকে পৃথিবী ঘোরে না আর পৃথিবীর মানুষ নিয়ম করে বিটিভি দেখে না। একজন চাকমার জাতিগত পরিচয় কখনও বাঙালি হতে পারে না_ এই ঐতিহাসিক আর নৃবৈজ্ঞানিক সত্য ১৯৭২ সালের ২৫ অক্টোবর মানবেন্দ্র লারমা তৎকালীন সংসদকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। চলি্লশ বছর পর সংশোধিত সংবিধানে আবারও একই ব্যবস্থাপত্র দেওয়া হলো যে, বাংলাদেশের জনগণ সবাই জাতি হিসেবে বাঙালি হবেন। পাকিস্তান আমলে পশ্চিমারা আমাদের বলতেন, পাকিস্তানি জনগণের জাতি হচ্ছে একটিই_ মুসলমান জাতি। আমরা তা মানিনি, আমরা বলেছি, আমরা জাতি হিসেবে কখনোই মুসলিম না, জাতি হিসেবে আমরা অবশ্যই বাঙালি। সরকার ও সাংসদরা সংবিধান সংশোধনের সময় জাতি ও জাতীয়তা প্রশ্নে বিশ্বের সমসাময়িক জ্ঞান থেকে বিযুক্ত হয়ে কাজ করেছেন, যা মূর্খতারই নামান্তর; আর এটাই সবচেয়ে বড় হতাশার জায়গা_ যে বাঙালি ২৪ বছর পাকিস্তানের জাতিগত/ভাষাগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজের জাতিগত/ভাষাগত পরিচয় অর্জন করেছে, স্বাধীন বাংলাদেশে সেই বাঙালিরাই আদিবাসীদের ওপর জাতিগত/ভাষাগত নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। যে বাঙালি ২৪ বছর পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে গণতন্ত্র অর্জনের জন্য, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেই বাঙালিরাই আদিবাসীদের ওপর সামরিক আধিপত্য বজায় রেখেছে। এক সময়কার নির্যাতিত বাঙালি অপরাপর জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে ক্ষমতার প্রশ্নে এখন নির্যাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ।
আমাদের প্রত্যাশা ছিল শাসকগোষ্ঠী সংবিধানে এই সত্য মেনে নেবে যে, বাংলাদেশ একটি বহু ভাষা, বহু জাতি ও বহু সংস্কৃতির বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ এবং এর মধ্য দিয়ে সব জাতির পরিচয়, অধিকার ও সংস্কৃতিকে স্থান দেবে; এভাবেই রাষ্ট্র হয়ে উঠবে সবার; কিন্তু দেখি আশার সে রুটিতে লাল পিঁপড়ে। আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনার যে বহুত্ববাদী নীতি বা বৈচিত্র্যের ভেতরে যে সংহতি তাকে নির্লজ্জভাবে পরিহার করে সংবিধানে ৯ অনুচ্ছেদে যুক্ত করা হয়েছে, 'ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তাবিশিষ্ট বাঙালি জাতি'র মতো অসত্য বাক্য। বাংলাদেশ কোনো একক ভাষা বা একক জাতির রাষ্ট্র নয়। বাংলাদেশে বাঙালি ছাড়াও আরও জাতির মানুষ বাস করে এবং তারা বাংলায় নয়, তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষায় কথা বলেন। সংশোধিত সংবিধানে এ দেশে বসবাসরত অন্য ভাষাভাষীর মানুষের মাতৃভাষাকেও পরিত্যাজ্য ঘোষণা করা হয়েছে। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হলেও অন্য ধর্মগুলোর অস্তিত্ব স্বীকার করেছে কিন্তু দেশের অন্য জাতিগুলোর ভাষার অস্তিত্বের ব্যাপারে আমাদের সংবিধান ভয়ঙ্কর শব্দহীন এবং নিশ্চুপ।
বাংলাদেশে প্রায় ৩০ লাখ আদিবাসী বাস করেন এবং তাদের কাছে সবচেয়ে অবমাননাকর শব্দ হচ্ছে 'উপজাতি'; আদিবাসীদের কাছে এটি 'বাতিল', 'পশ্চাৎপদ' ও 'পরিত্যাজ্য' একটি শব্দ। সংবিধানে উপজাতি হিসেবে চিহ্নিত করে প্রকারান্তরে তাদের অপমান করা হয়েছে; উপরন্তু বাংলাদেশে বসবাসরত বাঙালি ছাড়াও অপরাপর জাতির পরিচয়কে তুলে ধরতে গিয়ে একই সঙ্গে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী, সম্প্রদায় ইত্যাদি বিভিন্ন অভিধা ব্যবহার করা হয়েছে, যা নিতান্তই হাস্যকর এবং এগুলোর স্পষ্ট কোনো সংজ্ঞায়ন সংবিধানে নেই। এর মধ্য দিয়ে আদিবাসী পরিচয় নির্মাণে পবিত্র (?) সংবিধানে এক ধরনের দ্বিধা আর তালগোল পাকানো হয়েছে।
বাংলাদেশে হাজং, কোচ, বানাই, মারমা, চাকমা, গারো, সাঁওতাল, উঁরাও, মুণ্ডা, খাসিয়া, মণিপুরি, খুমি, খিয়াং, লুসাই, বম, ম্রো ও রাজবংশীসহ বিভিন্ন নৃতাত্তি্বক আদিবাসী জনগোষ্ঠী বসবাস করে। তারা তাদের স্বকীয়তা, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি, সমৃদ্ধ মূল্যবোধ ও ঐতিহ্য দিয়ে আমাদের দেশকে সমৃদ্ধ করেছেন। আমরা মনে করেছিলাম, ৪০ বছরে ভূরাজনীতির গতিপ্রকৃতি যেমন পাল্টেছে, জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা, মন-রুচিও অনেক পাল্টেছে, তাই এখন যে সংবিধান রচিত হবে তা কেবল ধর্মনিরপেক্ষ হলেই চলবে না, একই সঙ্গে ভাষানিরপেক্ষ, জাতিনিরপেক্ষ ও লিঙ্গনিরপেক্ষ হতে হবে। ভুলে গেলে ভুল হবে যে, বাঙালির একক জাতীয়তাবাদের দেমাগ ইতিপূর্বে আদিবাসীদের জন্য রাষ্ট্রীয় শান্তির ক্ষেত্রে বহুবিধ সমস্যাই কেবল পয়দা করেছে, কোনো সমাধান বাতলাতে পারেনি। শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে এ রকম ধারণা কাজ করে যে, একটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য মুছে ফেলতে না পারলে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা জোরদার হয় না। আমরা মনে করি, একক জাতীয়তাবাদের প্রাবল্য একটি ভুল প্রমিজ; বরং একটি দেশের জনবিন্যাস, ঐতিহ্য, ভাষা ও কৃষ্টির বহুমুখী বিচিত্র রূপই রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে; এটিই বৈচিত্র্যের ঐকতান বা বহুত্ববাদ_ বিউটি অব ডেমোক্রেসি। একক জাতিসুলভ দাম্ভিকতা বাদ দিয়ে দ্রুত এই সত্য বুঝতে পারলে রাষ্ট্রের জন্য বরং ভালো যে, বাংলাদেশ কোনো এক জাতি এক ভাষা আর এক ধর্মের রাষ্ট্র নয়; এটি অবশ্যই একটি বহু জাতি, বহু ভাষা ও বহু ধর্মের রাষ্ট্র; সংবিধানেও এর ইঙ্গিত আছে। কারণ সংবিধানে দেশের নাম পিপলস রিপাবলিক বলা হয়েছে, বেঙ্গলি রিপাবলিক বলা হয়নি; আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ বিভিন্ন দাবি থেকে আমরা তাই এক চুলও সরে আসতে পারি না। খুবই প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন যে, বিচ্ছিন্নতাবাদী আসলে কারা? যারা সংবিধানের ভেতর তাদের যথাযথ স্বীকৃতির জন্য লড়াই করছে তারা? নাকি যারা এই স্বীকৃতি না দিয়ে তাদের দূরে ঠেলছে তারা? আমরা মনে করি, সংবিধান কোনো ধর্মগ্রন্থ নয়, আমরা চাইলে আবারও একে সংশোধন করতে পারি, ক্ষমতাসীন সরকারের প্রধানমন্ত্রীও তাই বলেছেন। সেই আত্মম্ভর আশায় আদিবাসীদের যথাযথ সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিগুলো আবারও তুলে ধরছি। দ্বিধার দোলাচল আর অস্পষ্টতার কুয়াশা সরিয়ে সংবিধানে স্পষ্ট করে বসবাসরত ৪৬টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জাতিসত্তা, ভাষা ও সংস্কৃতির সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হোক। সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে 'বাংলাদেশ একটি বহু ভাষা, বহু জাতি ও বহু সংস্কৃতির এক বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ'_ এই বাক্যের সংযোজন করা হোক।
ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতামুখী অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোকে বলতে চাই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এগিয়ে চলার জন্য এবং আদিবাসীদের সমস্যার স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধানের ক্ষেত্রে তাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিষয়টি আবারও নতুন করে ভাবুন। বাংলাদেশ একটি বহু জাতির সম্মানজনক অংশীদারিত্বের রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত হওয়ার স্বপ্নকে ধারণ করতে সক্ষম হবে, এটাই প্রত্যাশা।
রোবায়েত ফেরদৌস : সহযোগী অধ্যাপক গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
robaet.ferdous@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.