ধর্ম-কুপ্রবৃত্তি দমনে মাহে রমজান by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

মানুষের সুপ্রবৃত্তিগুলো মানব মনে ইসলাম-নির্দেশিত শান্তি, শৃঙ্খলা, ঐক্য, সাম্য, মৈত্রী, ভ্রাতৃত্ব, প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা প্রভৃতি মহ ৎ কাজের প্রতি অনুরাগ এনে দেয়। আর কুপ্রবৃত্তি বা কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মা ৎ সর্য—এ ষড়িরপুসমূহ মানবজীবনে অনৈক্য, হিংসা, বিদ্বেষ, অন্যায়, অত্যাচার, ব্যভিচার, নির্মমতা, পাশবিকতা, হত্যাকাণ্ড, ধনসম্পদের
লোভ-লালসা, আত্মসা ৎ -প্রবণতা, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, চাঁদাবাজি, ঘুষ-দুর্নীতি, অশান্তি, বিশৃঙ্খলা প্রভৃতি অনৈসলামিক ও অমানবিক কার্যকলাপের উদ্ভব ঘটায়। মানুষের কুপ্রবৃত্তির এ তাড়না থেকে আত্মশুদ্ধির উপায় এবং উন্নততর জীবনাদর্শের অনুসারী হওয়ার জন্যই মাহে রমজানে রোজা রাখার বিধান করা হয়েছে। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করাকে অপ্রকাশ্য জিহাদ বলা হয়। এ মর্মে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘প্রকৃত মুজাহিদ ওই ব্যক্তি যে (সব জিহাদের পাশাপাশি) নফসের সঙ্গে জিহাদ করে অর্থা ৎ মনচাহি জীবনের বিরোধিতা করে।
কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ প্রভৃতি কুপ্রবৃত্তিগুলো মানুষের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এগুলো প্রকাশ্য চোখে দেখা যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায়। মানুষের অভ্যন্তরীণ বিষয় বিধায় এদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করাকে অপ্রকাশ্য জিহাদ; আরবিতে ‘বাতিনি জিহাদ’ বলা হয়েছে। একে ‘জিহাদে আকবর’ বা ‘বৃহত্তর জিহাদ’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। কারণ, কুপ্রবৃত্তিকে অতি সহজে দমন করা যায় না। মাহে রমজানে এর বিরুদ্ধে মানসিক সংগ্রাম করতে হয়। একদা নবী করিম (সা.)-কে ‘জিহাদে আকবর’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলো: হে আল্লাহর রাসুল! বৃহত্তর জিহাদ কী? তিনি বলেছেন: নফসের সঙ্গে জিহাদ করা।’ (বায়হাকি) মাহে রমজানে যে ব্যক্তি ক্রোধের সময় কুপ্রবৃত্তিকে দমন করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, সেই মস্ত বড় জিহাদকারী। নবী করিম (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘কুস্তিতে যে অন্যকে পরাজিত করে সে শক্তিশালী নয়, প্রকৃত শক্তিশালী ওই ব্যক্তি যে ক্রোধের সময় নিজেকে বশে রাখতে পারে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
রোজার মাধ্যমে কুপ্রবৃত্তির ওপর বিবেকের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়, এর দ্বারা মানুষের পাশবিক শক্তি অবদমিত হয় এবং রুহানি শক্তি বৃদ্ধি পায়। মুমিন বান্দা একমাত্র আল্লাহর ভয় ও তাঁর সন্তুষ্টির জন্য কুপ্রবৃত্তি দমন এবং যাবতীয় খারাপ কাজ পরিত্যাগ করে নিজেকে আল্লাহর কাছে বিলিয়ে দেওয়ার জন্য আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালান। তখনই প্রতিটি স ৎ কাজ ও আল্লাহর বিধান পালনে মানুষ খুঁজে পাবে প্রশান্তি। অস ৎ কাজ ও পাপাচার মানুষকে মর্মপীড়া দেবে। ধর্মীয় অনুশাসন অমান্য করা তার জন্য হবে চরম কষ্টকর। মানুষের ভেতর মনুষ্যত্ব, মায়া-মমতা, প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা, ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যের মতো মানবিক গুণাবলি ও আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি দরদ জাগ্রত হতে হবে। ফলে সে হবে একজন ইনসানে কামেল বা সফল মানুষ।
রমজান মাসের প্রশিক্ষণের ফলে একজন ধর্মভীরু মানুষ হালাল খানাপিনা এবং জৈবিক রিপুর তাড়না ও কামনা-বাসনা থেকে দূরে থাকতে সক্ষম হন। তাঁর পক্ষে আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী যাবতীয় হারাম কাজকর্ম, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, সুদ, ঘুষ, পরচর্চা, পরনিন্দা, মিথ্যাচার প্রভৃতি পরিহার করা মোটেই কঠিন ব্যাপার নয়। প্রতিটি রোজাদারের মধ্যে যখন মানবিক গুণাবলি বিকশিত হবে, প্রতিটি মানুষ যখন হবে প্রকৃত মানুষ; থাকবে না হিংসা-বিদ্বেষ, মারামারি, হানাহানি, সন্ত্রাস, ঘুষ-দুর্নীতি, অরাজকতা, সামপ্র্রদায়িকতা ও মানুষে মানুষে ভেদাভেদ। চূর্ণ হবে মানুষের অহমিকা ও আমিত্ববোধ, যা সব অন্যায় ও অনাচারের জন্মদাতা। সৃষ্টি হবে মানুষে মানুষে সম্প্রীতি। এ অশান্ত পৃথিবীর বুকে বয়ে চলবে শান্তির সুশীতল বায়ু। এ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়েই প্রতিবছর মাহে রমজান মুসলিম উম্মাহর দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়। রোজার মূল লক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি আর রোজার ব্যবহারিক উদ্দেশ্য হলো কুপ্রবৃত্তি দমন, আত্মসংশোধন, আত্মসংযম ও খোদাভীতি অর্জন।
রমজান মাসের রোজার মাধ্যমে রোজাদার খোদাভীতি অর্জন করেন, সৃষ্টিকর্তার শোকর আদায় করতে শেখেন এবং আল্লাহর হুকুমের কদর বুঝতে পারেন। প্রকৃতপক্ষে সব কাজকর্মের মধ্য দিয়ে রোজাদার মানুষ মূলত আল্লাহর আদেশ-নিষেধগুলোকে মেনে চলার চেষ্টা করেন। একসময় তাতে তিনি সফলকাম হন, তখন তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করেন। এভাবেই রোজাদার বান্দা আল্লাহর সান্নিধ্যে এগিয়ে যান, আর এটাই হলো মাহে রমজানে মানুষের পরম লক্ষ্য। এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘যে ব্যক্তি আহার করে (আল্লাহর) শোকর করে, তার মর্যাদা ধৈর্যশীল রোজাদারের সমপরিমাণ।’ (বুখারি)
আল্লাহর ওপর প্রগাঢ় বিশ্বাসে রোজাদার ব্যক্তির অন্তরে স্রষ্টার প্রতি ঐকান্তিক ঈমান জন্মে এবং খোদাপ্রেমে তার অন্তর উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। রোজা রাখার কারণে মানুষ নিজের নফস বা আত্মাকে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ প্রভৃতি কুপ্রবৃত্তি থেকে পরিপূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে। মানুষ তার সমস্ত কামনা-বাসনা ও লোভ-লালসা পরিত্যাগ করে বিভিন্ন যাতনা ও দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে খোদাভীতি অর্জনে ব্রতী হয়। তাই যদি কোনো রোজাদার ইখলাসের সঙ্গে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য নিজের ক্ষুধা-তৃষ্ণাসহ কুপ্রবৃত্তি দমনপূর্বক রোজা রাখেন এবং ধৈর্যের সঙ্গে যাবতীয় কষ্ট সহ্য করেন, তাহলে তিনি অবশ্যই সৌভাগ্যের অধিকারী হতে পারেন। মাহে রমজানের এ ত্যাগ-তিতিক্ষার শিক্ষাকেই ধৈর্যের শিক্ষা বলা হয়। রোজার মাধ্যমে কাল্বকে সুষ্ঠু রাখার পরিপূর্ণ ব্যবস্থা রয়েছে। এ কাল্ব (অন্তরের) অবস্থাকে পবিত্র ও নির্মল করার জন্য নামাজের পরই রোজার স্থান। নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার আশায় এবং পূর্ণ ঈমানদারির সঙ্গে যে রমজান মাসের সিয়াম পালন করবে, আল্লাহ তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেবেন।’ (মুসনাদে আহমাদ)
মাহে রমজানে সিয়াম সাধনা মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ও সাম্য সৃষ্টি করে। রমজান মাসের রোজা, পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, সেহির, ইফতার, তারাবির নামাজ, সাদাকাতুল ফিতর, দান-খয়রাত প্রভৃতি আল্লাহর অসংখ্য নিয়ামত, যা রোজাদারদের কুপ্রবৃত্তি দমন ও তাকওয়া বা খোদাভীতিপূর্ণ ইবাদতের মানসিকতা সৃষ্টিতে যথেষ্ট অনুপ্রেরণা জোগায়। মাহে রমজান বাস্তবিকই যেন মানুষের কুপ্রবৃত্তি বা পশুত্ব, আত্ম-অহমিকা, হিংস্রতাসহ সব অমানবিক দোষ-ত্রুটি ভস্ম করে এবং ধৈর্য-সহনশীলতা, প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা-হূদ্যতা এসব মানবিক গুণাবলি অর্জন করে যেন আমরা মুত্তাকি হয়ে মনুষ্যত্ববোধকে জাগ্রত করতে পারি, আল্লাহ পাক আমাদের এ সৌভাগ্য দান করুন।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.