স্মরণ-ভালো মানুষ বেশি দিন বাঁচে না by মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া

হূদয়ের খুব কাছের মানুষ তারেক মাসুদ চলে গেল এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ১৩ জুলাই ২০১১, শনিবার। এই লেখা আমার সেই প্রিয় অনুজের স্মরণে। আমি ছবি বানানোর জগতের লোক নই, ছবি দেখার জগতের লোক। তার পরও মুক্তিযুদ্ধ ছবির নির্যাস এমন কয়েকটি ছবি বানানোর সঙ্গে জড়িয়ে গেলাম।


চাষী নজরুল ইসলাম, তানভীর মোকাম্মেল, হুমায়ূন আহমেদ তাঁদের কামালপুর যুদ্ধ (বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য নির্মিত), রাবেয়া, ১৯৭১ (মুক্তির অপেক্ষায়) এবং শ্যামল ছায়া ছবি বানাতে গিয়ে আমাকে স্মরণ করেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার সামান্য গবেষণা আছে তাই।
একই কারণে তারেক মাসুদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক। মুক্তির গান, মুক্তির কথা, মাটির ময়না, নরসুন্দর নামের ছবিগুলো বানানোর আগে তারেক আমার সঙ্গে আলাপ করত। তারেককে আমি বিনয়ের সঙ্গে বারবার বলেছি যে চলচ্চিত্রের আমি কিছুই বুঝি না। তুমি সময় নষ্ট কোরো না। তারেক তার লেপ্টে থাকা হাসিটি নিয়ে জবাব দিয়েছে, আমি তো আপনার সঙ্গে চলচ্চিত্র নিয়ে আলাপ করতে আসি নাই। আমি এসেছি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলাপ করতে। মুখের হাসি আর সুহূদ আচরণের জন্য তারেক সহজেই সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে ওঠে। একসময় আমার এক প্রিয় অনুজ হয়ে উঠল সে। তার ছবিগুলোর প্রিমিয়ার শোতে আমাকে থাকতেই হবে আমার স্ত্রী রিফাত নিগার শাপলাসহ। খুব খুশি হতো সে। তার খুশি দেখে আমারও খুশি লাগত।
ছবি দেখে আমার মতামত জানাতে হতো। আমি কোনো কোনো বিষয়ে আমার ভিন্নমত প্রকাশ করেছি, মুক্তিযুদ্ধ চিত্রায়ণ ও উপস্থাপন বিষয়ে। আমি মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ করেছি, সমালোচনা শুনে তার মুখের হাসিটি কখনো মিলিয়ে যায়নি। জানার আগ্রহে তার কোনো কমতি নেই। তার ছবির জন্য প্রাসঙ্গিক নয়, এমন সব মুক্তিযুদ্ধের তথ্যও তার প্রয়োজন। কেন, জিজ্ঞাসা করলে বলত, কাজ আছে। কাজের মানুষ, কাজ থাকতেই পারে।
কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, ভিত্তিহীন বিশ্বাস, অবাস্তবতা আর গোঁড়ামির প্রতি ছিল তার দ্রোহ। এই দ্রোহ প্রকাশের মাধ্যম ছিল তার ছবি—স্বল্পদৈর্ঘ্য, পূর্ণদৈর্ঘ্য। তার ছবি দেখেছি এবং বারবার নিজেকে মনে করিয়ে দিয়েছি অতীতের যে অন্যায় এবং অসত্য ভুলে গিয়েছিলাম। তার তৈরি ছবি দেখি আর ভাবি, যার বোধ আছে, সে-ই বলতে পারে অবলীলায়। উদ্দেশ্য চিন্ময়ী হলেও মৃন্ময়ী কত কাজ করতে হয়। শুধু অর্থ, মেধা, আন্তরিকতা, সময় আর শ্রমই নয়; কী অপরিসীম ধৈর্য দেখেছি তারেকের। লক্ষ্য স্থির করতে সময় নিত, কিন্তু একবার লক্ষ্য স্থির হয়ে গেলে তা অর্জন করা পর্যন্ত আর বিরতি নেই। কী প্রচণ্ড অধ্যবসায়।
উজান বাইবার এই যাত্রায় তারেক মাসুদের পাশে সব সময় ছিল এক ঋদ্ধিমতী আমেরিকান মেয়ে, ক্যাথরিন শেপিয়ার—তারেকের স্ত্রী। প্রবল ঋজুতা দিয়ে ক্যাথরিন কোনো দিন তারেককে বাঁকা হতে দেয়নি। প্রচণ্ড অর্থকষ্টের কথা কখনো বলেছে আমাকে, বলেছে সে এগোতে পারছে না। ঠিক সেই সময়গুলো উতরে নিয়েছে একহারা গড়নের এই মেয়েটি। আকাশভরা স্বপ্ন নিয়ে দিনরাত সে ছিল তারেকের পাশে, ক্যাথরিন মাসুদ।
মুক্তিযুদ্ধের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান আছে আমাদের, সেন্টার ফর বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়্যার স্টাডিজ। একুশের বইমেলায় আমাদের দুটি স্টল থাকে। ওপরে বড় করে ব্যানারে লেখা থাকে ‘শুধুই মুক্তিযুদ্ধের বই’। সেই স্টলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা বিক্রেতার কাজ করে। আমি একটি উঁচু আসনে বসে থাকি। ভালো লাগে। পরিচিতজনেরা আসে, শিশুরা আসে, প্রবাসীরা আসে। বহুদিন পর বহু লোকের সাথে দেখা হয়। মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে জানতে আগ্রহী ছেলেমেয়েরা আসে। আসে বিদেশিরাও। আমি মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই নিয়ে আলাপ করি। একদিন ভিড়ের মধ্যে এক মহিলা স্টলে এসে আমার লেখা কয়েকটি বই নিয়ে আমার সামনে এলেন আমার সাথে কথা বলতে। আমি বুঝতে না পেরে একজন ছেলেকে দেখিয়ে দিলাম এই ভেবে যে তিনি বইগুলো কিনবেন। ওপরে তাকিয়ে দেখি, ক্যামেরায় ছবি তোলা হচ্ছে। এটা হয়। বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়া বইমেলায় ছবি তোলে। আমি স্বাভাবিক। হঠা ৎ দেখি একটু পেছনে ক্যাথরিন ও তারেক। দুজনেই সবগুলো দাঁত বের করে হাসছে। দুজনেই দুই হাত ওপরে তুলে নাড়ছে। ওদের দেহভঙ্গিতে বুঝলাম, তাদের আয়োজনে করা শুটিং হচ্ছে এবং আমি যেন স্বাভাবিক থাকি। বার্তা পেলাম। ফেব্রুয়ারি ২০১১-এর বইমেলায় আমাদের শেষ দেখা। এই পাগল দম্পতি মুক্তিযুদ্ধ বা এ-বিষয়ক কোনো ছবি করছিল কি না, কে জানে।
তারেক আমাকে বলত, কামরুল ভাই, আপনার লেখা মুক্তিযুদ্ধের সত্য কাহিনিগুলো নিয়ে একটা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বানাব। আয়োজনটা সম্পন্ন করে নিই। আমি বলেছি, আল্লাহ যদি আমাকে বাঁচিয়ে ও সুস্থ রাখেন, ধরে নিয়ো আমি সব সময়ই আছি। একটা ভালো কাজ হবে।
ভালো কাজ করার ভালো মানুষগুলো কেন বেশি দিন বাঁচে না! তারেক, তোমার জন্য কিন্তু আমি তৈরি। তুমি কোথায়?
মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া (অব.)
মুক্তিযোদ্ধা, গবেষক ও লেখক। cblws1971@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.