রবীন্দ্রনাথ আছেন সবার হৃদয়ে by শাকিলা জাফর

রবীন্দ্রনাথ কীভাবে আমাকে প্রভাবিত করেছেন তা আমি কীভাবে বোঝাব। আমি নিজেকে রবীন্দ্রনাথের প্রেমিকা মনে করি। আমার মতো মনে হয় এমন অনেকেই আছেন। প্রথমে তাঁর গান শুনে, পরবর্তী সময়ে ছবি দেখে ভালো লাগত। তখন তাঁর গানপাগল ছিলাম, আস্তে আস্তে যত তাঁকে দেখেছি, তাঁর সৃষ্টি কর্মগুণকে দেখছি, আমি ততই মুগ্ধ হচ্ছি।


আমি রীতিমতো তাঁর সৃষ্টিতে মুগ্ধ এবং একজন অন্ধপ্রেমিকা। আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ একজন বিস্ময়। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির মধ্যে তাঁর গানই শুনেছি আগে। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর গানের প্রতিই আকৃষ্ট হয়েছি।
আমার মামা মনজুর আলম চিটাগং বেতারে গান করতেন, ভীষণ দরাজ গলা ছিল তাঁর। তিনি বাসায় খুব চর্চা করতেন, তখন থেকেই রবীন্দ্রসংগীত শোনা শুরু হল। এর আগে রবীন্দ্রসংগীত কী জানতাম না। ৮-৯ বছর বয়স থেকে জানা শুরু করলাম যে এটা রবীন্দ্রসংগীত। বড়ই হয়েছি আসলে রবীন্দ্রনাথের গান শুনে। পরবর্তী সময়ে মামার হারমোনিয়াম নিয়ে বসে নিজে নিজে গানগুলো কেমন করে যেন তুলে ফেলতাম আর গাইতাম।
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমি রবীন্দ্রসংগীত শিখিনি। আমাদের বাসায় একটা ছোট হোম টেপরেকর্ডার ছিল, ওই রেকর্ডারে আমরা টেলিভিশন থেকে গান রেকর্ড করে সারাদিন শুনতাম। তখন ক্যাসেট প্লেয়ার আসেনি। রেডিও ছিল না। সে সময় টেলিভিশনে গান হলেই রেকর্ড করে রাখতাম, আর খুব শুনতাম। তখনই আস্তে আস্তে রবীন্দ্রনাথের গান শুনতে শুনতে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গানের প্রচণ্ড ভক্ত হয়ে গেলাম। শুনতে শুনতে ওগুলো মুখস্থ হয়ে গেল।একসময় আমার আগ্রহ দেখে বাবা মা ওস্তাদ রেখে দিলেন। আমি উচ্চাঙ্গসংগীত শেখা শুরু করলাম। তারও অনেক পরে ক্লাসিক্যাল চর্চা শুরু হলো। ১৯৭৭ বা ১৯৭৮ সালের দিকে এসএসসি পাসের পর আমি ক্লাসিক্যাল শুরু করলাম। এর আগে রবীন্দ্রসংগীত, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান এবং আকাশবাণী কলকাতা আর টেলিভিশনে দেখতাম সাবিনা ইয়াসমীন, ফজলে এলাহি, ইসমত আরা_এঁরা গান গাইছেন। তাঁদের গানই শুনতাম। এরই মধ্যে আমার আধুনিক আর ক্লাসিক্যাল গাওয়া শুরু হয়ে গেছে।
তখনো মনের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ গুন গুন করত। মনের ইচ্ছাটা তখন আসলে চাপা পড়ে গেছে। কিন্তু বাসায় ঠিকই গাইতাম। আমার মনে আছে রবীন্দ্রনাথের একটা গান আছে 'ঘাটে বসে আছি আমি'। প্রায়ই আমি ভাবি রবীন্দ্রনাথের গানের কথা, যে তাঁর গান কখনো পুরনো হয় না। সবাই গাইছে একই গান, আমিও গাইছি, আমার সঙ্গে আরেকজন শিল্পীও গাইছেন। কিন্তু একেকজনের গায়কির কারণে, তার ইমোশনের কারণে, তাঁর গান পুরনো আর হয় না।
এমন একটা গানও নেই, যেটাকে বলবে যে এ গানটা আমার ভালো লাগে না বা এটা আমার জানা গান, আর কত শুনব! কিন্তু তার গানে ওই জিনিসটা নেই। অর্থাৎ, একেকজন শিল্পীর গায়কির সৌন্দর্যের কারণে গানগুলো প্রতিবারই নতুন মনে হয়। যেন আবার নতুন করে শুনছি। এটাই আমার কাছে অবাক লাগে। আজ সকালেই আমি রবীন্দ্রসংগীত শুনছিলাম। তখন মনে হলো গানগুলো এখনো কত প্রাণবন্ত।
সব গানের ক্ষেত্রেই এর শুদ্ধতা এবং ভাবটা বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ন। বিশেষ করে রবীন্দ্রসংগীতের শুদ্ধতার কথা আমি বলব যেহেতু তিনি একেবারে কাগজে-কলমে সুরগুলো লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। এই গানগুলোর শুদ্ধতা তো বজায় রাখা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথের গানও তাই, আমি যদি তাঁর স্বরলিপিটাকে নিজের মতো করে করি, তাহলে তাঁর স্বরলিপিটিকে আমার অবমাননা করা হবে।
সে জন্য একজন আধুনিক শিল্পী হিসেবে আমি আমার রবীন্দ্রসংগীতের এ্যালবাম 'লাবণ্যে পূর্ণে প্রাণ' এ এই বিষয়গুলো ঠিক রাখার চেষ্টা করেছি। চেয়েছি যেন তাঁর স্বরলিপিটিকে ঠিক রেখে সুরে গাইতে পারি। হয়তো রবীন্দ্রনাথের গানের নিজেস্ব গায়কী আছে, সেটা হয়তো আমার নেই এবং আমি চাইও না ওই গায়কীটিকে এনে রপ্ত করে গাইতে। ওই যে যেভাবে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়া হয়, যেমন ভরাট গলায়। আমি সুর, স্বরলিপি এবং বাণী_এ কয়টাকেই আমার কাজে প্রাধান্য দেওয়ার চেষ্টা করেছি। এখন ফিউশনের একটা ট্রেন্ড চলছে। নতুনরা এখন বিভিন্নভাবে রবীন্দ্রনাসংগীত গাইছে। ব্যান্ডের শিল্পীই হোক আর যেকোনো শিল্পীই হোক_আমি মনে করি যে ফিউশনের জায়গায় ফিউশন, রবীন্দ্রনাথের গানের জায়গায় রবীন্দ্রনাথের গান। যখন ফিউশন করা হচ্ছে তখন গানের যে ভাব, সেটা ঠিক রেখে যদি ফিউশন করা হয়, আর সেটা যদি শুনতে ভালো লাগে, তাহলে এটা কোনো বিষয় নয়। আমরা কিন্তু রবীন্দ্রনাথর গান তবলা, বোল, সারেঙ্গি, অ্যাসরাজ_এগুলো দিয়ে শুনতে অভ্যস্ত। তাই ফিউশনটা কানে লাগে। কিন্তু এই ফিউশনটাই যদি শ্রুতিমধুর হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই শুনতে ভালো লাগবে।
আশা ভোঁসলে রবীন্দ্রসংগীত করেছেন এবং তিনি কিন্তু তাঁর মতো তাঁর স্কেলে করেছেন। শুনতে কত ভালো লাগে। কারণ তিনি রূপটাকে ঠিক রেখেছেন।
রবীন্দ্রনাথের গান কোনটা ভালো লাগে, সেটা আলাদাভাবে বলা যাবে না কখনোই। কারণ আমার কাছে এটা সমুদ্র সেচে মুক্ত খোজার মতই। আমার এখনো মনে আছে, প্রথম মামার কাছ থেকে শুনে যে গানটা আমার মনে গেথেছিল, সেটা হলো 'যেতে যেতে একলা পথে নিভেছে মোর বাতি' খুব কঠিন একটা গান। মামা আমাকে বলেছিলেন, এটা যদি তুই ওঠাতে পারিস, তোকে ১০টা পয়সা দেব। ১০ পয়সা তখন অনেক। আমার কাছে মনে হলো, আরে বাবা ১০ পয়সা হলে তো আমি তিন-চারটা আচার কিনে ফেলতে পারব। ওটাই ছিল আমার প্রথম পছন্দের গান এবং ওটাই আমি এখনো গুন গুন করি।
'এ মনিহার আমারে সাজে', 'আমারও পরানও যাহা চায়' খুব ভালো লাগে। এরপর যখন অ্যালবামের কাজ করলাম তখন অবাক হয়ে দেখলাম কত সুন্দর সুন্দর গান আছে। সেগুলো আমার জন্য একটা নতুন শেখা হলো।
অন্য সবার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গানের পার্থক্য অবশ্যই আছে। রবীন্দ্রনাথের গানের মতো গান কেউ কি লিখতে পেরেছেন? নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ এমন কিছু ব্যক্তির গান ছাড়া অন্য গানের বেলায় আমরা জিজ্ঞাসা করি, এটা কার গান। কিন্তু নজরুল, রবীন্দ্রনাথের গান জিজ্ঞাস করি না যে এটা কার গান বরং আমি গান শুনে, এর বাণী বা সুর শুনেই বলতে পারি এটা নজরুল বা রবীন্দ্রনাথের গান।
রবীন্দ্রনাথের গান বোঝা কিন্তু খুব কঠিন। তবে সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে যে বোঝা কঠিন হলেও কিন্তু প্রত্যেকটা মানুষ নিজের মধ্যে রবীন্দ্রনাথকে লালন করে রাখে। একটা ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে আমরা সবাই কিন্তু রবীন্দ্রসংগীত গুনগুন করি। আসলে রবীন্দ্রনাথ নাই কার মাঝে?
তিনি আছেন সবার হৃদয়ে ।

No comments

Powered by Blogger.