কালান্তরের কড়চা-পদ্মা সেতু ও বিশ্বব্যাংক নেপথ্যের খেলা by আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী

শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থ সাহায্য না দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। ছোট মুখে বড় কথা বলছি। বিশ্বব্যাংক যে পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থায়নে এগিয়ে আসবে না- এই কথাটা আওয়ামী লীগ সরকারের দু-একজন কর্তাব্যক্তিকে আমি আগেই বলেছি। তাঁরা বলেছেন, একটু অপেক্ষা করে দেখুন।


আমাদের অর্থমন্ত্রী তো একসময় বিশ্বব্যাংকের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন। তা ছাড়া আমাদের প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে আমেরিকায় খয়ের খাঁ গওহর রিজভী আছেন। তাঁরা চেষ্টা করছেন। তা ছাড়া পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে মাত্র। দুদকের তদন্তে তা প্রমাণিত হয়নি। এখনো তদন্ত চলছে। বিশ্বব্যাংককে তাই এই অর্থ সাহায্য দিতে হবে।
আওয়ামী লীগ সরকারের এই আশা পূর্ণ হয়নি। তারা ভেবেছে যুক্তির কথা। আমি ভেবেছি রাজনৈতিক চক্রান্তের কথা। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করার ব্যাপারে যুক্তির পথ অনুসরণ করেছে বা দুর্নীতি দূর করা তাদের লক্ষ্য ছিল, তা আমার মতো ক্ষুদ্র বুদ্ধির মানুষের কখনো মনে হয়নি। মনে হয়েছে, এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে। সেই উদ্দেশ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ক্লিনটন দম্পতি ও শক্তিশালী মার্কিন এস্টাবলিশমেন্টের অনুগ্রহভোগী এক নোবেলজয়ীর প্রতিশোধস্পৃহা।
আমার গোড়া থেকেই মনে হয়েছে, গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম যাদের দ্বারা সৃষ্ট ও পুরস্কৃত তাদেরই এক 'এজেন্টের' ব্যক্তিগত স্বার্থরক্ষার জন্য একটি গোটা জাতিকে শাস্তি দিতে চায়। হাসিনা সরকার যদি শুরুতেই গ্রামীণ ব্যাংক-সংক্রান্ত তাদের সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ থেকে সরে আসত, তাহলে এ শাস্তি তারা সম্ভবত এড়াতে পারত। এক ব্যক্তির স্বার্থ ও জেদ রক্ষার জন্য একটি সুপার পাওয়ার একটি গরিব দেশের ওপর কী ধরনের নগ্ন চাপ দিতে পারে এবং এই চাপ প্রদানের কাজে বিশ্বব্যাংককে ব্যবহার করতে পারে, পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধ করার ব্যাপারে ব্যাংকের সিদ্ধান্ত তার প্রমাণ।
আমার এই কথাগুলো উড়ো কথা নয়। বিশ্বব্যাংকের এই সিদ্ধান্তের পাশাপাশি সম্প্রতি আর যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা আমার এই কথার সত্যতার প্রমাণ দেবে। ড. ইউনূস আমেরিকা তথা গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের কত বড় 'নয়নের মণি', তার প্রমাণ, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এবার বাংলাদেশ সফরে এসে প্রথমেই গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে প্রকাশ্যে হাসিনা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। নতুন মার্কিন দূত মজিনা সাহেবও ঢাকার মাটিতে পা রেখেই গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ বাড়ানোকে প্রায়োরিটি দেন।
এটা ছিল বাংলাদেশের একটি অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বিদেশি হস্তক্ষেপ ঘটানোর উলঙ্গ চেষ্টার প্রকাশ। অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরেও চলে স্যাবোটাজমূলক কাজ। গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অপসারিত হওয়ার পর এবং দেশের সর্বোচ্চ আদালত তাঁর এই অপসারণকে বৈধতা দেওয়া সত্ত্বেও ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকের অসংখ্য কর্মী ও শেয়ারহোল্ডার গ্রামীণ মহিলাদের কাছে চিঠি লিখে সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার জন্য উস্কানি দিতে থাকেন। এই উস্কানি শুধু সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নয়, পরোক্ষভাবে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধাচরণ করারও উস্কানি। এটা আইনত অপরাধ। সরকার বিদেশি চাপের মুখে দুর্বলতা দেখিয়ে এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
ড. ইউনূস এখানেই থামেননি। গত ২৮ জুন তারিখটি ছিল তার ৭৩তম জন্মদিবস। এ দিন ঢাকার অদূরে সাভারে আমাদের আরেক কীর্তিমান পুরুষ জাফরুল্লাহ সাহেবের গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রে ড. ইউনূসের জন্মদিন পালনের ব্যবস্থা হয়। রতনে রতন চেনে। তাই জাফরুল্লাহ সাহেব ড. ইউনূসের প্রতিভার কদর করতে দেরি করেননি। অদূর ভবিষ্যতে তাঁকেও নোবেল পুরস্কার না হোক, ব্রিটিশ নাইটহুড দেওয়া হলে বিস্মিত হব না।
এই জন্মদিনের সভাটিকেও ড. ইউনূস ব্যবহার করেছেন তাঁর গ্রামীণ ব্যাংক-সংক্রান্ত সরকারবিরোধী প্রোপাগান্ডার কাজে। সম্প্রতি তিনি নতুন অর্থনৈতিক থিওরিও দিয়েছেন। বলেছেন, ভারতের বাজারে বাংলাদেশি ডিম যে দিন বিক্রি করা যাবে, সে দিনই নাকি আমাদের অর্থনৈতিক সাফল্যের প্রমাণ পাওয়া যাবে। ভারত সরকারের উচিত, তাঁকে 'ভারতরত্ন' খেতাবে ভূষিত করা।
ড. ইউনূস গর্ব করে বলেন, গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা শতকরা ৮০ ভাগ গ্রামের নিরক্ষর মহিলাদের। কিন্তু তাঁর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে এই মহিলাদের উপস্থিতি দেখা যায়নি। দেখা গেছে সারা বিশ্ব থেকে আমন্ত্রণ করে আনা বিদেশি অতিথিদের জাঁকজমকপূর্ণ উপস্থিতি। তাঁর নিজের জেলা চট্টগ্রাম যখন প্লাবনে ভাসছে, ভূমিধসে অসংখ্য নর-নারীর মৃত্যু ঘটেছে, তখন তিনি বিদেশি মেহমান নিয়ে জাঁকজমকপূর্ণ জন্মদিন পালনে ব্যস্ত। জাতীয় দুর্যোগের (National calamity) সময় কেউ ঘটা করে জন্মদিন পালন করে না।
চট্টগ্রামের পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার থেকেও দাঙ্গাপীড়িত রোহিঙ্গারা এসে এ সময় আবার ঢুকছিল। বাংলাদেশ সরকার আর্তমানবতার এই সমস্যা নিয়ে বিব্রত। এ সময় শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ীর শান্তি মিশন ও শান্তি প্রচেষ্টা কোথায়? তিনি জন্মদিনের উৎসব পালন ও গ্রামীণ ব্যাংক পুনরুদ্ধারের যুদ্ধে ব্যস্ত। গান্ধী শান্তি প্রতিষ্ঠায় নোয়াখালীতে পদযাত্রা করেছিলেন।
আমি ড. ইউনূসের সাম্প্রতিক কার্যকলাপ নিয়ে আলোচনা করতে চাই না। আমার কথা, বাংলাদেশের প্রস্তাবিত পদ্মা সেতুর অর্থায়নে বিশ্বব্যাংকের অসম্মতি ঘোষণার পাশাপাশি যেসব ঘটনা ঘটছে, তার সঙ্গে এই ঘোষণার বিস্ময়কর একটি পারম্পর্য দেখা যায়। মনে হয়, এই ঘটনাগুলো যেন বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তেরই পরিপূরক। নইলে বাংলাদেশ যখন প্লাবন ও রোহিঙ্গা সমস্যায় বিব্রত, তখন মার্কিন সিনেটের ১৮ জন মহিলা সদস্য দেশটির এই বিপদে সমবেদনা না জানিয়ে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে চাপ সৃষ্টির জন্য চিঠি লেখেন কেন?
বিশ্বব্যাংক হয়তো আশা করেছিল, পদ্মা সেতুর অর্থায়ন দুর্নীতির অভিযোগে স্থগিত ঘোষণার পর সুপার পাওয়ার আমেরিকাসহ পশ্চিমা অনেক দাতা দেশ এবং দুর্নীতি সম্পর্কিত তাদের অভিযোগের মুখে হাসিনা সরকার পিছু হটবে। হাসিনা সরকার দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে দুদককে তদন্ত করতে দিয়েছে। দুদক এখনো তদন্তে কিছু পায়নি। সেতু প্রকল্পে মধ্যবর্তী এজেন্টদের যে লেনদেনের দুর্নীতির কথা ঢাকঢোল পিটিয়ে বলা হচ্ছে, তা যদি সত্য হয়, তাহলেও দেখা যায়, তা শুধু প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে। আসল লেনদেন হয়নি। তাহলে বিশ্বব্যাংক কি অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হওয়ার আগেই পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন না করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে এ কথাই প্রমাণ করল না যে এ সিদ্ধান্ত মোটেই দুর্নীতির জন্য নয়, এ সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত?
বিশ্বব্যাংক হয়তো আরো আশা করেছিল, গ্রামীণ ব্যাংক ও আরো কয়েকটি বিষয়ে বাংলাদেশের ওপর আমেরিকাসহ কয়েকটি পশ্চিমা দাতা দেশের চাপ সফল না হলে বিশ্বব্যাংকের অর্থনৈতিক চাপের কাছে ঢাকাকে নতিস্বীকার করতেই হবে। হাসিনা সরকার এখনো নতিস্বীকার করেনি। তাই কি এই উলঙ্গ চাপ? বহু গরিব ও উন্নয়নশীল দেশে গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের শক্তিশালী মহাবাহু বিশ্বব্যাংক এই খেলা খেলেছে। বাংলাদেশেও সেই খেলারই পুনরাবৃত্তি ঘটানো হলো। এটি একটি সরকারের বিরুদ্ধে নয়, একটি দেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত।
(বাকি অংশ আগামীকাল)
লন্ডন, ২ জুলাই, ২০১২, সোমবার

No comments

Powered by Blogger.