পদ্মা সেতু প্রকল্প-কালো মেঘ কেটে যাক

অবশেষে বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নের ঋণচুক্তি বাতিল করল বিশ্বব্যাংক। যে কথিত দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংক এই সিদ্ধান্ত নিল সেটি দুঃখজনক, বিব্রতকর। বিশ্বব্যাংকের এই সিদ্ধান্ত খুব দ্রুতই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। গতকালই এডিবি বিশ্বব্যাংকের পদাঙ্ক অনুসরণের কথা জানিয়ে দিয়েছে।


জাইকা ও আইডিবির সিদ্ধান্ত অভিন্ন হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। পূর্বাপর ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করে আমাদের মনে হয়েছে, দুর্নীতির ন্যায় সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্রে দূরদর্শিতার অভাব ছিল। সরকার অভিযুক্ত মন্ত্রীর দফতর বণ্টন ও কর্মকর্তা বদলি, তদন্তের সঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশনকে জড়িত করা এবং ওয়াশিংটনে এ ব্যাপারে সমঝোতার চেষ্টা চালালেও বিশ্বব্যাংকের কাছে এগুলো যথেষ্ট বলে বিবেচিত হয়নি। অনেকে বলতে পারেন, যে প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থছাড়ই করা হয়নি সেখানে দুর্নীতির প্রশ্ন আসে কী করে! প্রকল্প শুরু করার আগে, এমনকি প্রকল্প গ্রহণের পর্যায়েও ঘুষ চাওয়া বা দেওয়া এমনকি সমার্থক ইঙ্গিত দেওয়া বিশ্বব্যাংকের বিবেচনায় দুর্নীতির পর্যায়ে পড়ে। আমাদের দুর্ভাগ্য, সরকার আসে সরকার যায়, দুর্নীতি বটবৃক্ষের মতো বেড়েই ওঠে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সহমত, বলিষ্ঠ ও অর্থবহ অঙ্গীকার ছাড়া দুর্নীতি নির্মূল করা সম্ভবও নয়। পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বাতিলের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য দুর্নীতিবিরোধী কতিপয় পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে সরকার দুর্নীতিবিরোধী অভিযান জোরদার করতে পারে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিধান ও নিয়ম মেনে দুর্নীতির অভিযোগ বিশ্বাসযোগ্যভাবে তদন্ত করা এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে সরকার নিজের ও দেশের ক্ষতিগ্রস্ত ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে পারে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ব্যাপারে দ্রুত তদন্ত এবং দোষী হলে তাদের শাস্তি দিয়ে বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব। বিশেষজ্ঞদের মতো আমরা মনে করি, পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের পথে সৃষ্ট অন্তরায় দূর করতে আন্তরিক উদ্যোগ নিতে হবে।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এখনও আলোচনার মাধ্যমে এ বিরোধ নিষ্পত্তির আশা করছেন। অচিরেই বিশ্বব্যাংকের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। এটা এখন সর্বজনস্বীকৃত যে, বাংলাদেশের দ্রুততর ও ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়নের জন্য পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণের বিকল্প নেই। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত করার মাধ্যমে সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখবে এই প্রকল্প। বিশ্বব্যাংক এই প্রকল্প থেকে অর্থায়ন বাতিল করে দেওয়ায় সে সম্ভাবনা ধাক্কা খেল। হয়তো বিকল্প ব্যবস্থাপনায় এই সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। কিন্তু এতে প্রকল্পের ব্যয় যেমন বেড়ে যাবে, তেমনি এর ওপর কয়েক দশক পর্যন্ত সরকারের নিয়ন্ত্রণও থাকবে না। বিনিয়োগকারীরা নিজেদের সুদ-আসল ও লাভ তোলার জন্য সেতুর ওপর দিয়ে চলাচলের ওপর মাত্রাতিরিক্ত টোল ধার্য করতে পারে। ফলে সেতুর আসল উদ্দেশ্য অনেকাংশে ব্যাহত হবে।
ঋণচুক্তি বাতিল করে আবার পুনর্বহাল করা হয়েছে বিশ্বব্যাংকের কার্যক্রমে এমন নজির রয়েছে। আমাদের মর্যাদা, সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনার পথ উন্মুক্ত করা বিশেষ জরুরি। এতদসত্ত্বেও বিশ্বব্যাংকের অনুদার মনোভাবে পরিবর্তন না এলে আমাদের যে কোনো মূল্যে যে কোনোভাবে প্রয়োজনীয় অর্থসংস্থান করে পদ্মা সেতু নির্মাণের কার্যক্রম গ্রহণ করতেই হবে। আমরা মনে করি, রাজনৈতিক ক্ষুদ্র স্বার্থের ওপরে উঠে পদ্মা সেতুকে রাষ্ট্রের একটি জরুরি প্রকল্প হিসেবে বিবেচনা করে এর বাস্তবায়নে সকলে ঐকমত্য পোষণ করবেন। পদ্মা সেতু হতেই হবে_ এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
 

No comments

Powered by Blogger.