চারদিক-খাটি আর তিন বেলা খাই by সুচিত্রা সরকার

‘কাটা, ছেঁড়া, জমানো চুল থাকলে বেচতে পারেন...। পঞ্চাশ গ্রাম এক শ টাকা... এক শ গ্রাম দুই শ। আছেনি চুল, লাগব চুল...।’ সুর করে হাঁকতে হাঁকতে এগোচ্ছেন রাস্তা বরাবর। পরনে শার্ট আর লুঙ্গি। গলায় একটি গামছা ঝোলানো। বাঁ হাতে টিপ, ফিতা আর খেলনার একটি ব্যাগ। তার পাশেই চুলবোঝাই একটি ঝোলা।


মাঝ রাস্তায় পথ আগলে দাঁড়াই। ‘খানিকক্ষণ কথা বলার সময় হবে?’ মেঘলা আকাশটা একঝলক দেখে নিয়ে রাজি হয়ে যান। পাশের চায়ের দোকানে বসি তাঁকে নিয়ে।
কী নাম আপনার?
গলার গামছাটা হাতে নিয়ে এক টানে মুখের ঘামটুকু মুছে নেন। তারপর বলেন, ‘মুকুল শেখ।’
গ্রামের বাড়ি?
‘মুজিবনগরের তারানগর গ্রামে।’
এই পেশায় এলেন কীভাবে?
‘চাইর বছর হইছে। গ্রামের একজন কইছিল, এই পেশায় লাভ বেশি। পুঁজিও লাগে না। এই যেমন, এক শ গ্রাম চুল কিনি দুই শ ট্যাকায়। বেচি সাড়ে তিন শ ট্যাকায়। দিন শ্যাষে দুই শ, নাহয় আড়াই শ গ্রাম চুল কিনতে পারি।’
তাঁর সঙ্গে থাকা খেলনার ঝোলা দেখিয়ে প্রশ্ন করি, এগুলোও বিক্রি করেন?
একরাশ হতাশা নিয়ে বলেন, ‘কী আর করব! শুধু চুল কিনে পোষায় না। আবার বাচ্চাকাচ্চারা খেলনা দেইখা মায়ের কাছে আবদার করে। তখন হেরাও চুল বেচতে চায়। তহন দুইটাই বেচা হয়। অনেক সময় মায়েরাও নেয় না। কয়, “স্বামীরে আগে জিজ্ঞাস করি, তারপর বেচব।” না নিলে নাই, আমি রাস্তায় রাস্তায় হাঁক দেই, যে বেচবার, বেচব!’
কথায় কথায় অনেক দুঃখগাথা বের হয়ে আসে। মুকুল শেখ পড়াশোনা করেছেন অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত। সে সময় বাবা মারা গেলে তাঁর পড়াও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর নিজেদের জমি, বর্গা জমি আর দিনমজুরি করে সংসার চালাতেন মুকুল। সংসার ছোট ছিল। মা আর দুই ভাই। এখন পরিবারের আয়তন বেড়েছে। বিয়ে করেছেন পাশের গ্রামে। তারপর ছেলে এসেছে কোলজুড়ে। তখনই ঢাকায় এসে এই পেশা শুরু করেন।
নিজেই বলেন, ‘না এলে কী হইত বলেন! না খাইতে পাইয়া মারা যাইতাম সকলে। গ্রামে তো কোনো কাজ নাই। দিন পনেরো আগে গ্রামে গেছিলাম ট্যাকা দিতে। অবস্থা খুব খারাপ। রোদের তাপে জমির ক্ষ্যাত সব পুইড়্যা গ্যাছে। তাইলে প্যাট তো চালাইতে হইব।’
চুলগুলো কিনে নিয়ে বিক্রি করেন কোথায়?
‘মহাজনের কাছে। মিরপুরের কালসির বাজারে মহাজন আছে। আমার মহাজন কামাল মহাজন। সে কিনে মেশিনে চুলগুলা সাইজ করে। তারপর সেই দিয়া কী করে কইতে পারব না।’
থাকেন কোথায়?
‘কামাল মহাজনই থাকবার জায়গা দিছে। তার আন্ডারে ৫০ জন লোক কাজ করে। সবাইরে সে থাকনের জন্য ঘর ভাড়া করে দেয়। আমরা ১২ জন একটা ঘরে থাকি। থাকি আর কই? সকাল সাতটায় বের হই। আর রাত্রে গিয়া ঘুমায়া পড়ি।’
তাহলে খাওয়ার ব্যবস্থা কোথায়?
গভীর চিন্তায় পড়ে যান যেন মুকুল শেখ। তারপর বলেন, ‘সকালে কলা আর রুটি খাই। হাঁটতে হাঁটতে পিপাসা লাগলে চায়ের দোকানে পানি খাই।’ বলতে বলতে যেন সত্যি পানি পিপাসা পেয়ে যায় তাঁর। চায়ের দোকানিকে নিজস্ব কায়দায় হাঁক দেন, ‘এক গ্লাস পানি দেন তো?’
ঢকঢক করে এক গ্লাস পানির সবটুকু সাবড়ে নেন। তারপর আবার শুরু করেন, ‘আর দুপুরে ফুটপাতে ভাতের দোকানে গিয়া ভাত খাই। এক প্লেট ভাত আর তরকারি। তয় এহন খুব গরম। ভাত আর খাই না। ভাত খাইলে গরমে ঘুম পায়। হের বদলে রুটি আর গুড় খাই। ট্যাকাও কম লাগে। দশ ট্যাকায় পেট ভইরা যায়। আর রাইতে নিজে রাইন্ধা খাই। গরিবের জীবনে আর কী আছে, কন?’
দেশের রাজনীতি নিয়ে কি ভাবেন?
বেশ মজা পেয়েছেন এমন ভঙ্গিতে একগাল হাসেন। তারপর বলেন, ‘রাজনীতি নিয়া ভাবি না। রাজনীতি নিয়া ভাবব, মনের সেই পরিস্থিতি নাই। আমাদের আর কী! খাটব আর খাব। রাজনীতির কাছে কোনো আশা নাই।’
এই পেশায় আর কত দিন থাকবেন?
ক্লান্ত-বিধ্বস্ত মুখটা আরও অসহায় হয়ে যায়।
গলার স্বরটাও যায় নেমে। ‘ইচ্ছা তো করে, আবার গ্রামে গিয়া চাষবাস করি। কিন্তু পুঁজি নাই।’
দীর্ঘশ্বাস পড়ে বার দুয়েক।
একটু থেমে আবার শুরু করেন, ‘আমাদের আর পুঁজি কী। খাটি আর খাই। তিন বেলা তিন মুঠ ভাত খাইয়া ঘুমাই।’
তবু মুকুল শেখ স্বপ্ন দেখেন। আবার গ্রামে গিয়ে জমি চাষ করবেন। দুপুরবেলা পরিবারের সবাইকে নিয়ে খাবেন। জমির ধানের গরম ভাত আর টাকি মাছের ভর্তা। আর শীতের সকালে দাওয়ায় বসে রোদ পোহাবেন।
সুচিত্রা সরকার

No comments

Powered by Blogger.