লুৎফর রহমান রনো-বিশ্বায়নের দর্পণে ভারত আমরা কি সতর্ক?

বর্তমান বিশ্বের প্রেক্ষাপটে ভারত একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে এগোচ্ছে। ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অভাবনীয় নয়, তবে বিশ্বায়নিক আশানুরূপ উত্থান বটে। পাশাপাশি সমরাস্ত্রের দিক দিয়ে বিশ্ব তালিকায় বেশ ওপরের দিকে, আর দক্ষিণ এশিয়ার পরাশক্তি হিসেবে ভারতের অবস্থান সুদৃঢ়।


সম্প্রতি কূটনৈতিক সাফল্যের সুযোগে রাশিয়া ও আমেরিকার সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি হওয়ায় সেরা গণতান্ত্রিক দেশটাকে খোদ যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা সমীহ করে চলছে এবং ভারতের স্বার্থকে অনেক ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিচ্ছে। তাদের এক বছরে মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৫ শতাংশ। এর ফলে মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ৪৬ হাজার ৪৯২ ডলার। শিল্পোন্নতির কাঙ্ক্ষিত পথে দ্রুত অগ্রসরমান ভারত। যে দেশ যত বেশি পরিবেশ বিধ্বংসী কার্বন নির্গত করে, সে দেশই তত উন্নত। এদিক দিয়ে ভারত চীন-কোরিয়ার কাছাকাছি পেঁৗছে যাচ্ছে। ভারতের বাজারও বড়। ১২০ কোটি লোকের দেশ। তাই মুক্তবাজার পৃথিবীতে ভারতের বাজার ধরে রাখার জন্য ধনী দেশগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা তো রয়েছেই। বিশ্বায়নের স্বপ্নদ্রষ্টা আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, এডিবি ও ইউরোপ-আমেরিকার মুক্তবাজার অর্থনীতির কারণে ভারত, ব্রাজিল, কোরিয়া, চীন, তাইওয়ান প্রভৃতি দেশ নাকি এখন উন্নতির চূড়া স্পর্শ করতে যাচ্ছে। অর্থাৎ এসবই বিশ্বায়ন নামক জাদু-অর্থনীতির ফল বলে ফলাও করছে বিশ্ব মোড়লরা, বিশ্বায়নের হোতারা। আমাদের বাংলাদেশও যদি বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ মতো চলে, তাহলে খুব দেরি হবে না, দু-চারজন আম্বানির জন্ম হয়েই যাবে। অতএব সবাই বলবে নিশ্চয়ই_জয়তু বিশ্বায়ন। এবার বিশ্বায়নের শনৈঃ শনৈঃ উন্নতির অগোচরে যা ঘটে চলেছে, তার দিকে তাকানো যাক। ১৯৯১ সালে ভারত বিশ্বায়নের নীতিগুলোকে পুরোপুরি সমর্থন করে। ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভের একটি গবেষণাপত্র থেকে জানা যায়, ১৯৮৯-৯০ সাল পর্যন্ত দারিদ্র্য হ্রাস পাচ্ছিল। কিন্তু ১৯৯৯-২০০০ সাল অবধি কাঠামোগত সংস্কারের ফলে দারিদ্র্য বেড়েছে। আর এই সময়ের মধ্যে স্থায়ী শ্রমিকের পরিবর্তে অস্থায়ী ও ঠিকা শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে। হিসাব অনুযায়ী, ভারতে ৯১ শতাংশ মানুষই অসংগঠিত ক্ষেত্রে নিযুক্ত। এদের মধ্যে বেশির ভাগই কৃষিশ্রমিক হিসেবে স্বনিযুক্ত বা দিনমজুর। ২০০০ সালে অর্থনৈকি সমীক্ষায় দেখা গেছে, কৃষি খাতে শ্রমিকদের আয় আগের চেয়ে কমে আসছে ক্রমাগত। ভারতের বিস্ময়কর তরক্কির তলায় আরো অন্ধকারের খবর ভীতিপ্রদ। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতার (২৫ হাজার টাকার নিচে) সংখ্যা ছিল ৯৫ শতাংশ। ১৯৯৮ সালের মার্চের দিকে তা কমে এসে দাঁড়িয়েছে ৮৭ শতাংশে। একই সময়ে খেলাপি ঋণ ২৩.১ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ১২.৫ শতাংশে। অর্থাৎ ঋণগ্রহীতাদের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে বিত্তশালীদের বাজারে অর্থের জোগান নিশ্চিত করতে।
বিশ্বায়ননীতি যে বিশ্বের তাবৎ ধনীদের ভোগ-বিলাসের দুনিয়া গড়ে তোলার নীতি, তা আরো স্পষ্ট হয় নিচের একটি তথ্য থেকে। আমরা যে ভারতের অর্থনৈতিক উন্নতির কথা দেখেশুনে অবাক হই অজান্তে, সেই ভারতে এক বছরে, ২০০৯ সালে ১৭ হাজার ৩৮৮ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। ভারতে আগের চেয়ে তা সাত শতাংশ বেশি। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো (এনসিআরবি) তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ৩৭ বছরের মধ্যে ২০০৯ সালে সবচেয়ে কম বৃষ্টিপাতের কারণে ফসল ভালো না হওয়ায় কৃষকের মাথায় ঋণের বোঝা বেড়ে যায়। আর এই বঞ্চনার জীবন থেকে মুক্তির লক্ষ্যে বেছে নেয় আত্মহননের পথ। ২০০৯ সাল পর্যন্ত গত ১০ বছরে ভারতে দেড় লাখ কৃষক আত্মহত্যা করেছে। অন্যদিকে উদ্ভব ঘটেছে প্রায় ২০ কোটির মতো একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। বলা হচ্ছে, আজকাল ভারত ও চীনের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দামি আহার-বিহার বিশ্বে খাদ্যসংকট সৃষ্টির একটি অন্যতম কারণ। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ বা উপরোক্ত ২০ কোটি ধনী লোক ভারতের কৃষিজমির ৬০ শতাংশ এবং মোট আয়ের ৫০ শতাংশ উপভোগ করে। এরাই রাজনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদার অধিকারী এবং তাদের বেশির ভাগই গোঁড়া, ধর্মনিরপেক্ষতার চেয়ে হিন্দু সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্বের ধারণায় বিশ্বাসী। সংখ্যালঘু, নিম্নবর্গীয় বা দলিত সম্প্রদায় প্রভৃতি শ্রেণীর মানুষই কৃষিশ্রমিক। আর জাতিবিদ্বেষ বা দরিদ্র শোষণনীতির কারণেই সাম্যবাদী ভূমি বণ্টন বা ভূমিসংস্কার-প্রক্রিয়া কার্যকর করা যায়নি। এমনকি এই নিম্নবর্গীয়রা বীজ, জলসেচ, সার ইত্যাদিতে প্রযুক্তি উন্নয়নের মাধ্যমে তথাকথিত সবুজ বিপ্লবেরও সুফল পায়নি। ব্যতিক্রম কেবল কেরালা রাজ্যে বামপন্থী রাজনৈতিক দল ও প্রগতিশীল আন্দোলনের চাপে সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন-ব্যবস্থা ভেঙে গেছে। যা হোক, ভারতে বিশেষ করে গ্রামের দারিদ্র্যঘন মানুষের জীবন আরো বঞ্চনাময় হয়ে উঠেছে। এমনকি শিশুমৃত্যুর হারও কমাতে পারেনি ভারত। প্রায় আগের অবস্থায় রয়ে গেছে। অতএব, ভারতের ধনীকুলের ধনার্জন ও যুদ্ধবাজ দুনিয়ায় তাদের সমরাস্ত্রের উন্নয়ন দেখে অবাক হওয়ার কিছু নেই এবং এ ভাবার অবকাশ নেই যে ভারতের মানুষের উন্নয়ন ঘটেছে। ভারতের ওই ২০ কোটি মধ্যবিত্ত শ্রেণী বা ধনী লোকের মতো লোকদেরই উন্নয়ন-প্রক্রিয়া চলছে বিশ্বায়নের বিশ্বে। আর দরিদ্রদের মাথায় ক্রমাগত দারিদ্র্যের বোঝা বাড়ছে। বাংলাদেশও সে পথেই হাঁটছে। একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণী ইতিমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে, আর তাদের জন্যই ধীরে ধীরে গড়ে উঠবে বড় বড় শিক্ষালয়, চিকিৎসালয়, আধুনিক নগর-শহর-বন্দর। গ্রাম-শহরের গরিবের জীবন অনতিক্রম্য অন্ধকারেই আটকে আছে। তুমুল তোড়জোড় সত্ত্বেও শিক্ষার আলো, চিকিৎসার সুযোগ পৌঁছছে না। প্রাকৃতিক দুর্যোগে পর্যুদস্তদের পুনর্বাসন হচ্ছে না। গোলকায়নের গোলকধাঁধায় সব কিছুই বাধা পড়ে যায়। আমাদের এখনই সতর্ক হওয়া আবশ্যক।
লেখক : সাংবাদিক
ronokk1969@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.