জাহান্নামের আগুনে পুষ্পের হাসি by রাজীব নন্দী

এক ধরনের নিস্তব্ধতা চারদিকে। পাহাড়ধসের খবর আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে জন্মভূমি চট্টগ্রামে। পাহাড় ঘুরে সরেজমিন রিপোর্ট করতে গিয়ে দেখছি নিজের শৈশব-কৈশোর মাখা মায়াবী চট্টগ্রামের এক বিধ্বংসী রূপ।
'শহরের বোঝা' ছিন্নমূল, কালো কালো মানুষগুলো পাহাড়ের তলায় গিয়ে জীবন মেগেছিল।


আজ পাহাড়ই তাদের ওপর সওয়ার হয়ে মৃত্যু উপহার দিয়েছে। মাটির চাপে গহিন গোপন ব্যথা বুকে নিয়ে ঘন ঘোর দামিনীতে এলোমেলো হয়ে গেছে তাদের জীবন।
অথচ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কত অফুরন্ত আয়োজন নিয়ে চাটগাঁ ভূখণ্ড অধীর আগ্রহে পথিকদের পথ চেয়ে থাকত। হৃদয়ের ক্ষুধা, অন্তরের অতৃপ্তি_ এসবই কত না পর্যটকের গৃহ প্রাচীরের আবেষ্টনী থেকে মুক্ত করে সুদূর চট্টগ্রামের অনন্ত আহ্বানে সাড়া দিত! চট্টগ্রামের পাহাড়, ঝর্ণা আর সমতল সমানে টেনে নিয়ে চলত। ইতিহাস ও ভূগোলের এমন প্রত্যক্ষ আর অবারিত সানি্নধ্য গায়ে মেখে ধন্য হতো।
আজ এক বুক কাদাপানি আর পাহাড়ের মাটি নিয়ে এলো মৃত্যু আতঙ্ক। আমার শহরটা, যে শহরে আমি জন্ম নিয়েছি, আমার শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের প্রিয় চট্টগ্রাম আজ উদভ্রান্ত যৌবনা! কী ছিল না এখানে? সাগরের বেলাভূমি, পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা, ছায়ায় মায়ায় মোড়ানো পথ, মনজুড়ানো জলাশয়। আজ হতশ্রী চেহারায় ক্লেদাক্ত কুশ্রীরূপে দুর্যোগের কুবলয়ে বন্দি আমার ভূমি। গত ২৫ জুন বৃষ্টির বেগ বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হলো বজ্রবিদ্যুতের প্রলয়নৃত্য। বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে কোথা থেকে এসে দমকা হাওয়াও ছড়িয়ে যেতে লাগল সবখানে। সুষ্ঠু বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনার অভাবে জাতীয় অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড চট্টগ্রামের অসহায় মুখচ্ছবি বেরিয়ে পড়ল। সভ্যতার তলার মানুষ হয়ে পাহাড়ের চাপে মরল দলে দলে লোক। 'বীর চট্টলা'র বিদ্রোহী রূপ নিষ্ঠুর প্রকৃতির কাছে হয়ে গেল অসহায় বন্দিনী রাজকুমারী।
গত বুধ ও বৃহস্পতিবার সরেজমিন চট্টগ্রামের একাধিক ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় পরিদর্শন করতে গিয়ে দেখলাম কেবল চারদিনের টানা বৃষ্টিপাতের পরই চট্টগ্রামের ১৩টি পাহাড়ে বসবাসকারীদের উচ্ছেদ করে জেলা প্রশাসন। এর মধ্যে রোববার নগরীর লালখান বাজার এলাকার মতিঝর্ণা পাহাড়, বিশ্ব কলোনির কৈবল্যধাম সংলগ্ন পাহাড়, কুসুমবাগ পাহাড়, বাটালি হিল ও পুলিশ লাইন পাহাড়ের নিচে বসবাসকারী কয়েকটি পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়।
বীরেরা যুগে যুগে বলে গেছেন_ 'সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে/সার্থক জনম, মা গো, তোমায় ভালোবেসে।' 'ইলিয়াড'-এ গ্রিক বীর আগামেমনন দেশে ফিরে অশ্রুসিক্ত হৃদয়ে চুম্বন করেন দেশের মাটি। 'রামায়ণ'-এ রামচন্দ্রের মুখ দিয়ে উচ্চারণ- 'জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী।' মদিনায় হিজরত করতে যাওয়ার সময় অশ্রুসিক্ত নয়নে নবীজি বলেছিলেন, 'হুব্বুল ওয়াতানে মিনাল ইমান' (স্বদেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ)। আমার জন্মভূমি চট্টগ্রামের বিক্ষুব্ধ প্রকৃতির রূপ দেখে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় জন্মভূমির জন্য এভাবেই যুগে যুগে কেঁদেছেন বীরেরা।
চট্টগ্রামের দুরবস্থা নিয়ে যখন এই লেখাটি লিখছি তখন ফেসবুকের আলাপে অগ্রজপ্রতিম হিল্লোল দত্ত জানালেন_ 'আমিও মারা যাচ্ছি তুষার আমার প্রিয় চট্টগ্রাম নগরীটার সাথে। কে আগে মরবে জানি না, তবে শেষমেশ কেউই যে বাঁচবে না এবং তুষদগ্ধ সে মৃত্যু যে সুখমৃত্যু হবে না, সে নিশ্চিতিতে মুগ্ধ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলি শুধু।'
পাহাড়ের ঢালে শত শত মৃত্যুর সঙ্গে হঠাৎ চোখে পড়ল 'প্রাণ'। গত ৩০ জুন সমকালের প্রথম পাতায় প্রকাশিত ছবিটি হয়তো অনেকেই দেখেছেন। কাজলমাখা টানা টানা চোখে মায়াময় শিশুটি। যেন জীবন ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে পূর্ণতার অভিযাত্রায় শামিল কোনো যাত্রী। বর্ষাসিক্ত পড়ন্তবেলায় শিশুটি যেন বলছে_ একটিবারের জন্য হলেও আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখ। ভালোবাসায় আমাকে বুকে টেনে নাও। চট্টগ্রাম থেকে ফিরে সংবাদ লিখতে গিয়ে আমি ভাষা খুঁজে পাই না। এমন নিষ্পাপ ছবি তুলে দিই বার্তাকক্ষের রাশেদ উন নবী বাবু আর মুস্তাফিজ শফি ভাইয়ের হাতে। সময় তখন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। এমন নিষ্পাপ ছবি দেখে বাবু ভাই প্রথমেই বললেন, 'এ তো দেখি পুতুলের মতো সুন্দর।' ছবিটি 'সংবাদমূল্য' বিবেচনায় প্রথম পাতায় ঠাঁই করে নেয়।
পরদিন আমি চেয়ে থাকি শিশুটির কপালে। কুনজর থেকে বাঁচাতে শিশুর কপালে কালো ফোঁটা। জংধরা স্বপ্নপিণ্ডরূপী চট্টগ্রামে এ কোন শিশু? কোন দুঃসাহসে বৈরী প্রকৃতির বুকেও হাসছে শিশুটি? নিবিড় বাদল দিনে চিড়েচ্যাপ্টা পাহাড়ের ঢালে প্রাণবন্ত শিশুটিকে চিনে নিতে পারবে তো চট্টগ্রামবাসী। বাড়িয়ে বললে ভুল হবে না হয়তো; কবি সুকান্তও একদিন বলেছিলেন_ 'এই নিবিড় বাদল দিনে/কে নিবে আমায় চিনে/জানিনে তা।' জাহান্নামের আগুনে বসে এমন পুষ্পের হাসিমাখা মুখ কি সহজে ভুলবার?
rajib1nandy@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.