স্মরণ-খানবাহাদুর আহ্ছান উল্লা বহু গুণের অধিকারী by কুমার দাস

সাতক্ষীরা জেলার একেবারে শেষপ্রান্তে যে উপজেলার অবস্থান তার নাম কালীগঞ্জ। এ উপজেলারই একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম নলতা। শান্ত, শ্যামল ও সৌম্য গ্রাম নলতা। এ গ্রামটি আজ দেশ-বিদেশে ব্যাপকভাবে পরিচিত। এ গ্রামেই জন্মেছিলেন খানবাহাদুর আহ্ছান উল্লা।


এ দেশের অবহেলিত-অশিক্ষিত বাঙালি মুসলমান যুবকদের মধ্যে তিনি শিক্ষা বিস্তারে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। তিনি সারা জীবন ব্যয় করেন মানুষের কল্যাণে। বিখ্যাত আহ্ছানিয়া মিশনের প্রতিষ্ঠাতা তিনিই। খানবাহাদুর আহ্ছান উল্লা ১৮৭৩ সালের ডিসেম্বর মাসে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মুনশী মোহাম্মদ মুফিজউদ্দীন এবং মা মোছা. আমিনা বেগম। স্থানীয় স্কুলে লেখাপড়া শেষে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতা যান এবং ১৮৯৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে দর্শনে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। অতঃপর তিনি ব্রিটিশ সরকারের অধীনে শিক্ষা বিভাগে যোগ দেন এবং সহকারী ডিরেক্টর পদ পর্যন্ত অলংকৃত করেন। সরকারি কাজে নিযুক্ত থাকার সময় তিনি বিভিন্ন জেলা ও বিভাগে কাজ করেন। এসব স্থানে চাকরি করার সময় তাঁর বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়। তিনি লক্ষ করেন, মেধাবী মুসলমান ছাত্ররা প্রবেশিকা পরীক্ষায় ভালো ফল করতে না পেরে উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তিনি অনুসন্ধান করে দেখেন, পরীক্ষার খাতায় পরীক্ষার্থীর নাম থাকার কারণেই এ সমস্যা হচ্ছে। তিনি পরীক্ষার খাতায় পরীক্ষার্থীর নাম লেখার রীতি বিলোপ করে শুধু রোল নম্বর লেখার রীতির প্রচলন করেন। এ রীতি প্রচলিত হলে পরীক্ষকদের পক্ষপাতিত্বের সুযোগ থাকে না। তিনি মাদ্রাসা পাঠ্যসূচিরও মানোন্নয়ন করেন এবং মাদ্রাসা পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের উচ্চশিক্ষার পথ উন্মুক্ত করেন। খানবাহাদুর আহ্ছান উল্লা স্বীয় চেষ্টায় উচ্চশিক্ষা লাভ করেন এবং বাঙালি মুসলমান যুবকদের জন্য উচ্চশিক্ষার পথ প্রশস্ত করে যান। তিনি অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তিনি বাংলা একাডেমীর প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ছিলেন। শিক্ষা বিস্তারে তাঁর অসাধারণ ভূমিকার জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার তাঁকে খানবাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯২৯ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি এক বিরাট কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি ১৯৩৫ সালে নলতায় 'স্রষ্টার ইবাদত ও সৃষ্টির সেবা' এই আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রতিষ্ঠা করেন আহ্ছানিয়া মিশন। ১৯৬৪ সালে এর শাখা ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করেন। এ প্রতিষ্ঠানটি আজ দেশ-বিদেশে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছে এবং এ প্রতিষ্ঠান আরো অনেক সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের জন্ম দিয়েছে। খানবাহাদুর আহ্ছান উল্লার চরিত্রে বহু গুণের সমন্বয় ঘটেছিল। তিনি একাধারে ছিলেন শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারক, সুসাহিত্যিক, বাংলা ভাষার গভীর অনুরাগী, মানবসেবক এবং ইসলামী পণ্ডিত। নারী জাতি ও অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি তাঁর ছিল গভীর শ্রদ্ধাবোধ। তিনি জাগতিক কাজের পাশাপাশি ইহলৌকিক কাজেও বহু সময় ব্যয় করেন। তাঁর সিদ্ধজীবনের পরিচয় পেয়ে বহু মানুষ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর বহু হিন্দু ভক্তও দেখা যায়। ১৯৬৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি খানবাহাদুর আহ্ছান উল্লা ইহজগৎ ত্যাগ করেন। তাঁকে তাঁর জন্মস্থান নলতায় সমাহিত করা হয়। তাঁর সমাধিকে কেন্দ্র করে পরে নলতায় গড়ে ওঠে আজকের খানবাহাদুর আহ্ছান উল্লা সমাধি কমপ্লেঙ্। খানবাহাদুর আহ্ছান উল্লার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে প্রতিবছর ৮, ৯ ও ১০ ফেব্রুয়ারি তিন দিনব্যাপী এ সমাধিস্থলে ওরস মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী নির্বিশেষে তাঁর অসংখ্য ভক্ত-মুরিদ দেশ-বিদেশ থেকে নলতায় জড়ো হন। বসে মেলা। তখন নলতা ভিন্ন রূপ ধারণ করে। স্বপন কুমার দাস

No comments

Powered by Blogger.