বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৪৪৪ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। এ আর আজম চৌধুরী, বীর বিক্রম সাহসী যোদ্ধা সোনাবাড়িয়া সাতক্ষীরা জেলা সদর থেকে উত্তরে। কলারোয়া উপজেলার অন্তর্গত। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১৮-২০ তারিখে এখানে ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।


এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্ব দেন এ আর আজম চৌধুরী।
এ সময় ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধকৌশল ও সক্ষমতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চেয়েছিল। এটা যাচাইয়ের জন্য যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে নির্বাচন করা হয় বাংলাদেশের সাতক্ষীরা ও ভারতের হাকিমপুর এলাকাকে।
এ আর আজম চৌধুরী তখন যুদ্ধরত ছিলেন কুষ্টিয়া অঞ্চলে। এই যুদ্ধের জন্য তাঁকে সেখান থেকে হাকিমপুরে আনা হয়। তাঁর দলে ছিলেন ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে ১৮ সেপ্টেম্বর বিকেলে সোনাবাড়িয়া পৌঁছেন।
যুদ্ধের ছক অনুসারে সোনাবাড়িয়ায় যে স্থানে তাঁদের অবস্থান নেওয়ার কথা, সেখানে বাস্তবে ১০০ গজের বেশি উন্মুক্ত স্থান ছিল না। এ জন্য তিনি আরও ৫০০ গজ সামনে এগিয়ে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন। সেখানে ছিল একটি নালা।
১৯ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টার দিকে তাঁদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে হাজির হয় একদল পাকিস্তানি সেনা। তারা ছিল একটি জিপ, একটি পিকআপ এবং তিনটি তিন টনি লরিতে। সেগুলো আওতায় আসামাত্র এ আর আজম চৌধুরীর সংকেতে গর্জে উঠে সব মুক্তিযোদ্ধার অস্ত্র। পাকিস্তানি সেনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে গোলাগুলি চলে বিকেল পর্যন্ত।
এরপর পাকিস্তানি সেনারা আর্টিলারির সহায়তায় পশ্চাদ্পসরণ করে। সেদিন যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২০-২২ জন হতাহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের একজন শহীদ হন। পরের দিনও সেখানে যুদ্ধ হয়। সেদিন পাকিস্তানিরা দুই দিক থেকে আক্রমণ করে। এ আর আজম চৌধুরী সহযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে ওই আক্রমণ প্রতিহত করেন।
২১ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানিরা তিন দিক থেকে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এ দিনও তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু সেক্টর হেডকোয়ার্টার থেকে তাঁকে পশ্চাদ্পসরণ করতে বলা হয়। তখন তিনি পশ্চাদ্পসরণ করে হাকিমপুরে ফিরে যান।
এ আর আজম চৌধুরী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ছিলেন। ১৯৭১ সালে প্রেষণে যশোর ইপিআর সেক্টরের অধীন ৪ নম্বর উইংয়ে সহকারী অধিনায়ক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তখন তাঁর পদবি ছিল ক্যাপ্টেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
কুষ্টিয়ার যুদ্ধে তিনি সার্বিক নেতৃত্ব দেন। তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ৩০ মার্চ ভোর পাঁচটার সময় কুষ্টিয়ায় আক্রমণ করেন। ৩১ মার্চ পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। এই যুদ্ধে পাকিস্তানিদের চরম ক্ষয়ক্ষতি হয়।
এ আর আজম চৌধুরী প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান। পরে ৪ নম্বর সেক্টরের লালবাজার সাব-সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিভিন্ন স্থানে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন। বেশির ভাগ যুদ্ধেই তিনি অগ্রভাগে থাকতেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য এ আর আজম চৌধুরীকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৮।
এ আর আজম চৌধুরী স্বাধীনতার পর পর্যায়ক্রমে কর্নেল পদে উন্নীত হয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন। ২০০২ সালে মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার বাজিতপুর (চৌধুরীপাড়া) গ্রামে। বর্তমান ঠিকানা ১৩৭ ইস্টার্ন রোড, লেন ১৪, মহাখালী ডিওএইচএস, ঢাকা। তাঁর বাবার নাম আফতাবউদ্দিন চৌধুরী। মা হালিমা চৌধুরী। স্ত্রী জেসমিন চৌধুরী। তাঁদের তিন ছেলে।
সূত্র: জেসমিন চৌধুরী, মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান, বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৮।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.