বন্যা-দুর্গত মানুষের যন্ত্রণা আমরা কতটা বুঝি? by তুহিন ওয়াদুদ

প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদ তাঁর একটি কবিতায় শ্রমিকদের উদ্দেশ করে লিখেছেন, ‘শীততাপনিয়ন্ত্রিত ঘরে আপনারা কেউ কোনো দিন ঘুমোন নি।/ আর আমি জানি না হুইশালের শব্দে লাফিয়ে ছুটতে কেমন লাগে,/ আমি জানি না বস্তিতে ঘুমুতে কেমন লাগে,/ আমি জানি না খালি পেটে থাকার অভিজ্ঞতাটা কেমন।’


হুমায়ুন আজাদের কবিতার এই কয়েকটি চরণ উদ্ধৃত করেছি তাঁদের জন্য, যাঁরা জানেন না নদীভাঙনে সর্বস্ব হারালে কেমন লাগে, যাঁরা জানেন না বন্যায় বসতভিটা-সম্পদ সবকিছু ডুবে গেলে কেমন লাগে, যাঁরা জানেন না বাড়িঘর হারিয়ে দিশেহারা অবস্থায় অভুক্ত থাকলে যন্ত্রণাটা কেমন হয়; তাঁদের জন্য।
আমরা অনেকেই জানি না, এই কষ্টের স্বরূপ কী? ভিটেবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হওয়া পরিবারকে আমি দেখেছি, বাঁধের রাস্তার ওপর কী করুণ মূর্তিতে হতাশায় আচ্ছন্ন থাকেন তাঁরা। বন্ধু রতন সরকার বন্যাদুর্গত মানুষের কাছ থেকে ফিরে এসে আমাকে বলছিলেন, ‘মৃতের শোকে আচ্ছন্ন যেন ঘরবাড়ি হারানো মানুষগুলো! এই শোক ব্যাখ্যা করার ভাষা আমার জানা নেই!’ সত্যি, ঘরবাড়ি হারানো মানুষগুলোর মৃত্যু শোকই তো! কারণ, বাড়ির সঙ্গে তো আমাদের প্রেম হয়। সেই প্রেম আমাদের জীর্ণ ঘরের দেয়ালের সঙ্গে কিংবা উঠানের ছোট্ট বৃক্ষের সঙ্গেও। একজন মানুষ যখন আমাদের ছেড়ে চিরবিদায় নেন, তখন যেমন আমাদের কষ্ট লাগে, আবার ছোট ছোট অসংখ্য প্রেমের মায়ায় মাখামাখি করা বাড়িঘর যখন মৃত্যুবরণ করে, এমনকি যে মাটি গায়ে মেখে বেড়ে ওঠা, সেই মাটি পর্যন্ত যখন নদীগর্ভে বিলীন হয়, তখন মৃত্যু শোক ছাড়া আর কোন শোকে মূর্ছা যেতে পারে গৃহহীন মানুষগুলো? আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে রাজশেখর বসুর ‘লম্বকর্ণ’ গল্পে একটি ছাগলের সঙ্গে মানুষের কেমন নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ গল্পে একটি গরুর সঙ্গে গফুরের কত গভীর প্রেম রচিত হয়েছিল, তারাশঙ্করের ‘খোঁড়াশেখ’ গল্পে সাপের সঙ্গে মানুষের প্রেম, নজরুলের ‘পদ্মগোখরো’ গল্পের নায়িকার সঙ্গে সাপের প্রেম, সুবোধ ঘোষের ‘অযান্ত্রিক’ গল্পের একটি ভাঙা পুরোনো গাড়ির সঙ্গে গল্পনায়কের প্রেম, নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘পালঙ্ক’ গল্পে একটি পালঙ্কের সঙ্গে মকবুলের যে অস্তিত্বজনিত প্রেম; সে রকম অসংখ্য প্রেম একত্র করলেও আমাদের গৃহের সঙ্গে যে প্রেম রচিত হয়, সেই প্রেমের সমান নয়। এই প্রেমের সলিলসমাধি যার রচিত হয়, তার বুকে যে হাহাকার, তা একান্তই তার নিজের। কিন্তু রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে, যাতে করে নদীবর্তী মানুষ এই বিপদে না পড়ে, সেই ব্যবস্থা করা।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীতীরবর্তী গড়ে ওঠা গঞ্জই একসময় ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বাংলার প্রাচীন যে জনপদ গড়ে উঠেছিল, তা-ও নদীকে কেন্দ্র করে। প্রাচীনকালে নৌযোগাযোগ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সময়ের বিবর্তন হলেও বিশ্বব্যাপী নদীর প্রয়োজনীয়তা যখন অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে, ঠিক তখন বাংলাদেশের নদীগুলোর প্রতি অন্তহীন অযত্ন আমাদের ভীষণভাবে পীড়া দেয়। প্রতিবছরই দেশের কোনো না কোনো অঞ্চল প্লাবিত হয়। চরম পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশে যখন বাজেট উপস্থাপিত হয়, ঠিক তখনই বাংলাদেশে বন্যার সময়। চোখের সামনে লাখ লাখ মানুষের পানিবন্দী করুণ যাপিত জীবন দেখেও আমাদের সরকার তাদের জন্য বৃহৎ কোনো বরাদ্দ রাখে না। অথচ প্রতিবছর বন্যায় বিভিন্ন মাত্রার ক্ষয়ক্ষতি হয়। বন্যায় হাজার হাজার একর আবাদি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়, অনেক রাস্তাঘাট-হাটবাজার-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-ধর্মকেন্দ্র-ঘরবাড়ি নষ্ট হয়। আগুনে পুড়ে গেলেও জমিটুকু থাকে কিন্তু ভাঙনে সর্বস্বই যায়। এই যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়, তা মেরামত করতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। অথচ এই ক্ষতির থেকে স্থায়ীভাবে রক্ষা পাওয়ার উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ সরকার পরম্পরায় কাউকেই নিতে দেখা যায় না।
বন্যা এবং ভাঙন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমাদের প্রয়োজন ছিল নদীকে শাসন করা এবং তার প্রবাহ ঠিক রাখা। প্রতিবছরই নদী ভরাট হয়। উজান থেকে নেমে আসা ঢল এবং অতিরিক্ত টানা বর্ষণের ফলে সৃষ্টি হয় বন্যার। প্রতিবছর যেহেতু নদীর গভীরতা কমে আসে, সে জন্য প্রয়োজন ছিল নদী খনন করা। যদি গভীর করে নদী খনন করা যায়, তাহলে পানির প্রবাহ বেশি থাকলেও প্লাবিত হওয়ার ভয় থাকে না। একই সঙ্গে যদি খনন এবং পাড় শক্ত করে বাঁধার কাজ করা যায়, তাহলে ভাঙনও রোধ করা সম্ভব।
এ কাজটি না করার কারণেই প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে করুণ জীবন যাপন করে। সেই দৃশ্যটি এখন বাংলাদেশের অনেকগুলো নদীপারের মানুষের। দেশের সব গণমাধ্যমে এখন সেই বন্যার ভয়াবহ পরিস্থিতির খবর প্রচার করছে। বাড়িঘর ছাড়া লাখ লাখ মানুষ আশ্রয়হীন অবস্থায় অপর্যাপ্ত সরকারি ত্রাণে ওষ্ঠাগত প্রাণ হয়ে আছে। কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ বন্যাকবলিত হয়েছে। তাদের বিশুদ্ধ পানি, ওষুধ এবং খাবার-সংকটে পড়তে হয়েছে।
বন্যাকালীন খাওয়ার অনিশ্চয়তা চলছে। এর পরই শুরু হবে পানিবাহিত রোগ, যাতে করে এ রোগের হাত থেকেও রক্ষা পেতে পারে বন্যাদুর্গত মানুষ, সেই ব্যবস্থা নিতে হবে এখনই। এই যে লাখ লাখ মানুষ এখন বিপর্যস্ত হয়ে আছে, তারা যেমন জাতীয় অর্থনীতিতে এখনই কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না আবার তাদের জন্য ত্রাণ দিতে হচ্ছে। যদি নদীশাসনের যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া যেত, তাহলে বর্তমানের মতো এ অবস্থা সৃষ্টি হতো না, বরং সে পদ্ধতিতে নদী বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হতো। আর নদী বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হলে আমাদের কৃষি ও জলপথে যোগাযোগ অনেক উন্নত হতো। নদী বাঁচিয়ে রাখতে হলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোনো পরিকল্পনায় তা বাস্তবায়ন করা অসম্ভব। বন্যার্তদের সাহায্যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন সেবামূলক সংগঠন তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে পারে। স্থায়ী সমাধানের জন্য রাষ্ট্রীয় নদী খনন এবং পাড় বাঁধার জন্য বৃহৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা জরুরি।
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
wadudtuhin@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.