'আর নাই রে দেরি, নাই রে দেরি' by ডা. ওয়াহিদ নবী

যদিও সাধারণ নির্বাচনের আরো বাকি রয়েছে প্রায় তিন বছর, কিন্তু পৌরসভা নির্বাচনের ফলাফল একটা অনুভূতি এনে দিয়েছে যে 'নির্বাচনের আর নাই রে দেরি।' কথাটা সরকারি দলের জন্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। পর্যবেক্ষকরা পৌরসভা নির্বাচনের ফলাফলকে যথাযথভাবেই সরকারি দলের জন্য 'ওয়েকআপ কল' বলে বর্ণনা করেছেন।


'৯০ সাল থেকে শুরু করে নির্বাচনের ফলাফলের ইতিহাস স্মরণ করে সরকারি দলকে অবশ্যই সাবধান হতে হবে। ইতিহাস বলে, কোনো সরকারি দল আজ পর্যন্ত নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারেনি। সাধারণ নির্বাচনের সুবিশাল জয় যদি আওয়ামী লীগকে একটা অহমিকার মোহজালে ফেলে দিয়ে থাকে, তবে পৌরসভা নির্বাচনের ফলাফল তাদের মোহমুক্তি ঘটাতে সাহায্য করবে বা সাহায্য করা উচিত। সত্য বলতে কি, আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে জিতুক_এটি আশা করি। এর কারণ এই নয় যে আমি এ দলের সদস্য। আমি এ দলের সমর্থকও নই। তবু চাই আওয়ামী লীগ জিতুক। এর কারণ হচ্ছে, একটি সরকার বছরদশেক ক্ষমতায় না থাকলে তাদের পক্ষে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। আসলে সরকারের জঞ্জাল পরিষ্কার করতে কিছুটা সময় লাগে। তারপর পরিকল্পনা প্রণয়নেও বেশ কিছুটা সময় চলে যায়। আমাদের মতো দেশের নিজেদের যথেষ্ট অর্থ না থাকায় অন্য দেশ থেকে অর্থ জোগাড় করতে হয়। এ সবই সময়সাপেক্ষ।
প্রতিজ্ঞার বাস্তবায়ন ছাড়াও সরকারকে আরো অনেক কাজ করতে হয়। রুটিন কাজ রয়েছে, কিন্তু আসল সমস্যা হচ্ছে অপ্রত্যাশিত ঘটনা। সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড ম্যাকমিলান যেকোনো সরকারের এ সমস্যার কথা বলে গেছেন। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মতো অপ্রত্যাশিত ঘটনা সামাল দেওয়া ছিল একটা দুষ্কর কাজ। এ ধরনের ঘটনা পরিকল্পিত কাজে ব্যাঘাত ঘটায়। সব কাজ পিছিয়ে যায়। আমরা আশা করি, সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচার শেষ করুক তাদের এ শাসনামলেই। আমরা চাই, অনতিবিলম্বে বিচার শুরু হোক আর তাড়াতাড়ি বিচার শেষ হোক। অপরাধীদের শাস্তি হোক। কিন্তু ৪০ বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার নথিপত্র গুছিয়ে নিতে সময় লাগবে। এই দীর্ঘ সময়ে অনেক কিছুই অগোছালো হয়ে গেছে। অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে। শুনছি, কর্নেল তাহেরের গোপন বিচার-সংক্রান্ত অনেক কাগজপত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই দীর্ঘ সময়ে শত্রুপক্ষ সুযোগ পেয়েছে অনেক কিছুই তছনছ করে দেওয়ার। দলীয়করণে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে দেশের অনেক কিছু। অন্য অনেক কারণের জন্য যদি সরকার বদল হয়, তবে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, যুদ্ধাপরাধের বিচার আর হবে না; যদিও বর্তমান সরকারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল বলছে তারাও যুদ্ধাপরাধের বিচার চায়। তবে তাদের শর্তের দীর্ঘ তালিকা দেখে আমাদের মতো মানুষের মনে সন্দেহ জাগে। তাদের সহযোগীদের বিচার তারা করবে_এটা বিশ্বাস করা মুশকিল।
কিন্তু আমরা চাইলেই তো আর সরকারি দল পরের নির্বাচনে জিতবে না। সরকারকেও আন্তরিকভাবে জেতার জন্য চেষ্টা করতে হবে। জনগণকে বোঝাতে হবে, তারা নির্বাচনে জেতার উপযুক্ত। আর তাদের বোঝাতে হলে সরকারকে কিছু কাজ করতে হবে। গত দুই বছরের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে। ইতিবাচক কাজের দিকে মনোসংযোগ করতে হবে। প্রথমেই দেখাতে হবে, পৌরসভা নির্বাচনের 'ওয়েকআপ কল' তারা আন্তরিকতার সঙ্গে নিয়েছে। মনে হয়, দলের কার্যকরী সংসদের একটা বর্ধিত সভার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। উপজেলা ও জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক এবং সভাপতিদের সঙ্গে বৈঠকের প্রয়োজন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের। এ বৈঠকে গত দুই বছরে অভিজ্ঞতার পুঙ্খানুপুঙ্খ 'পোস্টমর্টেম' হওয়া প্রয়োজন। ভবিষ্যৎ কাজের পরিকল্পনা বাস্তব ভিত্তিতে করা উচিত। বিশেষ করে দলের শৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিস্তারিত আলোচনা করতে হবে। মন্দ হবে না, যদি নির্বাচনী ইশতেহারের একটা করে কপি দলীয় কর্মকর্তাদের আবার দেওয়া হয়। সরকারে থাকা দলের আরেকটি অসুবিধা। সরকার চালাতে হয়, আবার দল না চালালেও চলে না। এ অবস্থায় একজন সার্বক্ষণিক সাধারণ সম্পাদকের কথা বিবেচনা করা উচিত। ভদ্র-সজ্জন সব সময়ই দলের জন্য ভালো। তবে সাধারণ সম্পাদককে অবশ্যই হতে হবে কর্মঠ ও বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সাধুতার ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য-সদস্যাদের পছন্দ করেছিলেন। কেউই অসাধুতার বদনাম কুড়াননি। কিন্তু দুই বছর পর এখন তাঁদের অর্জনের হিসাব নেওয়ার সময় হয়েছে। তাঁদের উপযুক্ততা যাচাই করে দেখার সময় এসেছে।
কতগুলো ছোটখাটো ব্যাপার কিন্তু মানুষ পছন্দ করে না। সরকারি অনুষ্ঠান দেখতে পারিবারিক পুনর্মিলনী উৎসব বলে মনে হোক_কেউ এটা চায় না। বাংলাদেশের ব্যাপারে এ বিষয়টিকে আরো গুরুত্বসহকারে রাজনীতিবিদদের লক্ষ করা উচিত। কারণ রাজনীতির শত্রুরা রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের প্রভাব আছে বলে দাবি করে। দলের টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি আর গুণ্ডামি বন্ধ করা যায় না, সরকার কি এতই দুর্বল? এত দুর্বল সরকার জনগণ চাইবে না। ম্যাকিয়াভেলির অমর বাণী, 'দয়ালু সরকারকে লোকে পছন্দ করবে, তবে মান্য করবে না।' আমরা নিষ্ঠুর সরকার চাই না। কিন্তু শক্তিশালী সরকার চাই, যে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করবে। আইনশৃঙ্খলার অবনতি মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। আজ বহু বছর হয়ে গেল, ছাত্র সংস্থাগুলোর নির্বাচন নেই। অনির্বাচিত সরকার যদি জনগণ পছন্দ না করে, তবে অনির্বাচিত ছাত্রনেতাদের কেন তারা পছন্দ করবে? দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ একটা জটিল ব্যাপার। কিন্তু সরকারকে কিছু একটা করতে হবে। সিন্ডিকেটের কথা সরকার বলেছে। কিন্তু তারা অবাধে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে কী করে? নির্বাচনী ইশতেহারের অনেক কিছুই এখনো কার্যকর করা হয়নি। আমরা জানি, এতে সময় লাগে। তবে অপেক্ষাকৃত অপ্রয়োজনীয় কাজে হাত দেওয়া ঠিক নয়। সরকারের একনিষ্ঠ সমর্থক বৈমানিক আলমগীর সাত্তার লিখেছেন, একটি নতুন বিমানবন্দর নির্মাণ করার প্রয়োজন আগামী ৩০ বছরেও হবে না। আর এ নিয়ে প্রাণহানি সরকারের প্রতি মানুষকে সহানুভূতিশীল করে তুলবে না। বঙ্গবন্ধুর নামে বিমানবন্দর প্রধানমন্ত্রীসহ অনেককেই খুশি করে তুলবে। কিন্তু দায়িত্বশীলদের উচিত হবে, সব কিছু বিবেচনা করা। চাটুকাররা খুব বিপজ্জনক_এ কথা মনে রাখতে হবে। পাঁচ বছরের জন্য জনগণ একটা সরকার নির্বাচন করে। চিরদিনের জন্য নয়। এই অতি সহজ কথাটা মনে রাখা কিন্তু খুব সহজ নয়।
লেখক : লন্ডন প্রবাসী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.