বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি যেন জনস্বার্থসম্মত হয় by ড. এম শামসুল আলম

বিদ্যুৎ খাতে স্বচ্ছতা, দক্ষতা ও সক্ষমতার অভাবে বিদ্যুতের সরবরাহ ব্যয় প্রকৃত ব্যয় অপেক্ষা অনেক বেশি। ফলে বিদ্যুতের দাম বাড়ে। যেহেতু বিদ্যুৎ উন্নয়নের চালিকাশক্তি সেহেতু এর মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে না থাকায় এর বিরূপ প্রভাবে দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতি এখন হুমকির সম্মুখীন।


এমনিতেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বাড়ি ভাড়াসহ নানা দুর্ভোগ ও দুর্গতিতে জনগণ প্রায় দিশাহারা। তার ওপর বিদ্যুতের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির (তিন বছরে ছয় ধাপে মোট ১১০ দশমিক ৩৮ শতাংশ) উদ্যোগে সংগতই মানুষ ভীষণ উদ্বিগ্ন। এমতাবস্থায় অতীতের ধারাবাহিকতায় (বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বাল্ক বিদ্যুতের দাম ১০ শতাংশ ও ভোক্তা পর্যায়ে খুচরা বিদ্যুতের দাম পাঁচ শতাংশ বাড়ে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বাল্ক বিদ্যুতের দাম বাড়ে ১৬ শতাংশ ও খুচরা বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি পায় ছয়-সাত শতাংশ। বর্তমানে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি যদি যৌক্তিক ও সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়, তাহলে বিদ্যুতের অভাবে বিদ্যমান সংকট অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধিতে নিরসনের পরিবর্তে আরো জটিল হতে পারে।
তাই এ পরিস্থিতিতে অতীতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করে গত ২৫ জানুয়ারি কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ভোক্তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়, সরকার প্রতিবছর ৬০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে ঘাটতি মোকাবিলা করে। গত বছর আরো অতিরিক্ত ৪০০ কোটি টাকা ভাড়ায় বিদ্যুৎ কেনায় ভর্তুকি দিয়েছে। বিদ্যমান বিদ্যুৎসংকট, খাদ্যসংকট মোকাবিলার জন্য ভর্তুকি দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। এ প্রসঙ্গে খাদ্যসংকট অপেক্ষা বিদ্যুৎসংকট আরো ভয়াবহ উল্লেখ করে বলা হয়, কয়েক মাসেই নতুন খাদ্যশস্য বাজারে যখন আসে, তখন সংকট কেটে যায়। অথচ সঠিক ও যৌক্তিক পদক্ষেপ নেওয়া হলেও বিদ্যুৎসংকট কাটিয়ে উঠতে বছরের পর বছর পেরিয়ে যায়। আর সংকটের কারণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যেসব ক্ষয়ক্ষতি হয়, তা কাটিয়ে উঠতে আরো অনেক সময় পার হয়। তা ছাড়া খাদ্যসংকটে থাকা মানুষের পাশে সরকারসহ দেশ-বিদেশের সামর্থ্যবান মানুষ এসে দাঁড়ায়। বিনা মূল্যে বা স্বল্প মূল্যে বিশেষ ব্যবস্থায় খাদ্য সরবরাহ হয়, এমনকি লঙ্গরখানা খুলে বুভুক্ষুদের আহার জোগানো হয়। এভাবে খাদ্যসংকটে থাকা মানুষকে রক্ষা করা হয়। এর পরও খাদ্যের অভাবে মানুষ মারা যায়।
খাদ্যসংকটে যেমন খাদ্যের দাম অস্বাভাবিক বাড়ে, বিদ্যুৎসংকটেও তেমনি বিদ্যুতের দাম অস্বাভাবিক বাড়ে। কিন্তু এ সংকটে থাকা মানুষ, শিল্প-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য এ সব কিছুকে অস্বাভাবিক দামে নয়, সহনীয় দামে বিদ্যুৎপ্রাপ্তির কোনো উপায় বা পরিকল্পনা চোখে পড়ে না। বরং সংকটের অজুহাতে অভিনব উপায়ে বিদ্যুৎ কেনাবেচায় ব্যক্তি বা মহল বিশেষ লাভবান হওয়ার সুযোগ নেয় এবং সে সুযোগ অব্যাহত রাখতে সংকট দীর্ঘস্থায়ী হয়। তাই বিগত দুই সরকার মিলিয়ে আজ ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও বিদ্যুৎসংকট নিরসন বা উপশম না হওয়ার কারণ এখানেই। এই প্রেক্ষাপটে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারে ক্যাবের পক্ষ থেকে ১৯ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত গণশুনানির ভিত্তিতে বিইআরসিতে যে ১২ দফা সুপারিশ পেশ করা হয়, সেসব সুপারিশ এ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপন করা হয়। সুপারিশগুলো নিম্নরূপ :
১. ইতিপূর্বে বাল্ক বা পাইকারি বিদ্যুতের মূল্যহার যেসব শর্তাধীনে ১৬ শতাংশ বর্ধিত করার আদেশ দেওয়া হয়, সেসব শর্ত প্রতিপালন আশানুরূপ হয়নি। ফলে অগ্রগতি উল্লেখপূর্বক তা প্রতিপালনের রূপরেখা উল্লেখ করে মূল্যহার বৃদ্ধির আদেশ প্রদানসহ বেঁধে দেওয়া সময়সীমার মধ্যে ওইসব শর্ত পালনের বাধ্যতামূলক আদেশ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। ২. ইতিপূর্বে ভোক্তা পর্যায়ে ছয়-সাত শতাংশ বিদ্যুতের মূল্যহার বৃদ্ধি করা হয়। এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, এমন মূল্যহার ভোক্তা পর্যায়ে যেন বৃদ্ধি হয়, সে প্রস্তাব সুপারিশে রয়েছে। ৩. বাল্ক বিদ্যুতের মূল্যহার বৃদ্ধির ব্যাপারে বিইআরসির স্টাফরা যে প্রস্তাব করেছেন, তাতে এক হাজার কোটি টাকা ভর্তুর্কির প্রস্তাব করা হয়েছে। যেহেতু খাদ্যসংকটের মতোই বিদ্যুৎসংকটে ভর্তুকি দিয়ে সেই সংকট মোকাবিলা করার প্রস্তাব ক্যাব করেছে, মূল্যহার বৃদ্ধি করে সংকট মোকাবিলা করার ব্যাপারে ক্যাবের আপত্তি রয়েছে সেহেতু সামঞ্জস্যপূর্ণ বিদ্যুতের মূল্যহার বাল্ক ও খুচরা উভয় পর্যায়ে বৃদ্ধির পর যে পরিমাণ আর্থিক ঘাটতি থাকে তা ভর্তুকির মাধ্যমে পূরণের প্রস্তাব করা হয়েছে। ৪. গণশুনানিতে প্রতীয়মান হয়েছে, ব্যক্তি খাতের তুলনায় সরকারি খাতে তেল-বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেশি। এর অন্যতম কারণ প্লান্টগুলো পুরনো। ফলে অদক্ষ এবং প্লান্ট ফ্যাক্টর কম। এ অবস্থায় এসব প্লান্ট অবসরে যাওয়া এবং এর স্থলে নতুন প্লান্ট স্থাপন ও সেই সঙ্গে উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য নতুন প্লান্ট স্থাপনও জরুরি। সে জন্য গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের অনুরূপ বিদ্যুৎ উন্নয়ন তহবিল গঠন করা দরকার। এ তহবিলে যে পরিমাণ অর্থ বিদ্যুতের মূল্যহার বৃদ্ধি হতে গৃহীত হবে, এর সমপরিমাণ সরকার অনুদান হিসেবে এ তহবিলে প্রদান করবে_এমন শর্তে এ তহবিল গঠনের প্রস্তাব সুপারিশে রয়েছে। ৫. বিদ্যুৎসংকট মোকাবিলা এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনে গ্যাসের অভাবে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রয়েছে, সেই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং দ্বৈত জ্বালানিভিত্তিক প্লান্ট, উভয় ক্ষেত্রে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত কোনোভাবেই বিদ্যুৎ উৎপাদনে যেন বর্তমানের চেয়ে বেশি গ্যাস সরবরাহ করা না হয়, এ মর্মে নিষেধাজ্ঞার আদেশ দেওয়ার প্রস্তাব সুপারিশে রয়েছে। ৬. বিদ্যুৎসংকট মোকাবিলার জন্য ক্যাপটিভ বিদ্যুৎমালিক ও পাইকারি বা খুচরা ভোক্তা যেন পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে কোনো রকম বাধা ছাড়াই স্থানীয় পর্যায়ে বিদ্যুৎ কেনাবেচা করতে পারে, এ মর্মে আদেশ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। ৭. যেহেতু প্রতিবছর ছয় মাস অন্তর ১২ শতাংশ বৃদ্ধিতে তিন বছরে ১১০ দশমিক ৩৮ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির এই অটো প্রস্তাবে ক্যাবের আপত্তি রয়েছে, সেহেতু প্রতি মূল্যহার বৃদ্ধি গণশুনানির ভিত্তিতে হতে হবে। প্রয়োজনে সেই শুনানি জরুরি ভিত্তিতে স্বল্প সময়ে সম্পন্ন করা যেতে পারে। যে আবেদনের ভিত্তিতে গত ১৯ জানুয়ারি বিইআরসিতে গণশুনানি হলো, এ শুনানির ভিত্তিতে বিইআরসির আদেশ হওয়ার সঙ্গে সেই আবেদনের কার্যকারিতা শেষ হয়। ফলে পরবর্তী সময়ে নতুনভাবে আবেদন ছাড়া এবং সে আবেদনের ওপর নতুনভাবে গণশুনানি ব্যতীত কোনোভাবেই ন্যায্য ও যৌক্তিক মূল্যহার নির্ধারণ করা যায় না, এ মর্মে বিদ্যুতের এ মূল্যহার বৃদ্ধির আদেশের সঙ্গে বিইআরসির অভিমত প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে। ৮. বিদ্যমান রিফর্ম বিদ্যুৎসংকটের জন্য অনেকাংশে দায়ী। রিফর্ম যেন জনস্বার্থসম্মত হয়, সে জন্য চলমান রিফর্ম কার্যক্রম মূল্যায়নের ব্যাপারে ক্যাবের সঙ্গে পিডিবিও অভিন্ন মত পোষণ করে। ফলে সরকারের সম্মতিক্রমে রিফর্ম কার্যক্রম মূল্যায়নের জন্য বিইআরসি কর্তৃক যেন একটি কারিগরি কমিটি গঠিত হয়, সে জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। ৯. বিদ্যুসংকট নিরসনে দীঘিপাড়া ও খালাশপীরের খনির কয়লা জরুরি ভিত্তিতে উত্তোলনের ব্যাপারে বিইআরসির পক্ষ থেকে সরকারকে অনুরোধ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ১০. যেহেতু সংকট সৃষ্টিতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের অস্বচ্ছতাও অনেকাংশে দায়ী, সেহেতু এ খাতে দুর্নীতির যেসব অভিযোগ রয়েছে, তা নিষ্পত্তির জন্য দুদককে বিইআরসির পক্ষ থেকে অনুরোধ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ১১. সরবরাহ ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা না হলে শুধু ভর্তুকির মাধ্যমে ভোক্তাদের সহনীয় মূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। সে জন্য উৎপাদন ব্যয় যেন কম হয়, সে ধরনের নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণের বিকল্প নেই। তাই বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কমাতে হলে উৎপাদন ব্যক্তি খাতের তুলনায় সরকারি খাতে বেশি হতে হবে। ফলে সরবরাহকৃত বিদ্যুতে কমপক্ষে কী পরিমাণ (%) সরকারি খাতের উৎপাদিত বিদ্যুৎ হতে হবে, বিদ্যুতের এ মূল্যবৃদ্ধির আদেশে তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করার প্রস্তাব করা হয়। ১২. গণশুনানিতে প্রতীয়মান হয়েছে, যেহেতু শুধু অর্থ পেলেই পিডিবি তার নিজস্ব উৎপাদন ও উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বিদ্যমান বিদ্যুৎসংকট সহজেই মোকাবিলা করতে পারত, ব্যক্তি খাতের ক্ষুদ্র ও ভাড়া প্লান্টের চড়া দামে বিদ্যুতের প্রয়োজন হতো না, সেহেতু ক্ষুদ্র ও ভাড়া বিদ্যুৎ ব্যয়বহুল বিধায় ভবিষ্যতে এ ধরনের বিদ্যুৎ ক্রয় বা সরকারি খাতে উৎপাদনে বিধিনিষেধ আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বলা দরকার, গত দুই সরকারের আমলে কথিত রিফর্ম কার্যক্রমের আওতায় বিদ্যুৎ খাত বেসরকারিকরণের যেসব কার্যক্রম গৃহীত হয়েছে, তাতে সরকারি খাতে কম দামি বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রেখে অপরিকল্পিতভাবে ব্যক্তি খাতে বেশি দামি বিদ্যুৎ উৎপাদনে উৎসাহী করার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। তাতে রাষ্ট্রীয় সংস্থা পিডিবি বিলুপ্ত হতে বসে এবং জাতীয় জীবনে বিদ্যুৎসংকট নেমে আসে। বর্তমান সরকার পিডিবির বিলুপ্তির পরিবর্তে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিয়েছে। তাতে বিদ্যুৎ খাত প্রাণ পেয়েছে। কিন্তু বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানের জন্য এ উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। সে জন্য জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে সমন্বিত মহাপরিকল্পনা চাই। সেখানেই রয়ে গেছে বড় বেশি সংকট। তা জিইয়ে রেখে বিদ্যুৎসংকট নিরসন কিভাবে সম্ভব?

লেখক : জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষাবিদ

No comments

Powered by Blogger.