আমাদের যা প্রয়োজন by মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান

একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় শতকে বাংলাদেশ আজ এক নতুন সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে। গণতান্ত্রিক পরিবেশে, মুক্ত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোতে আমাদের প্রধানমন্ত্রী যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের ডাক দেন তাতে দেশের লোক অনুপ্রাণিত।


দেশের সাধারণ লোক অ্যানালগ-ডিজিটালের পার্থক্য বিচার করতে পারে না বটে, কিন্তু সোনার বাংলা সম্পর্কে তাদের একটি মোটামুটি ধারণা আছে। সোনার বাংলা হবে একটা সমৃদ্ধ দেশ। সেই সমৃদ্ধির অন্যতম যে শর্ত সেই বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও তথ্যপ্রযুক্তির একটা সুদৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করে শিক্ষার প্রসার ঘটানো প্রয়োজন। সেই সমৃদ্ধির রূপায়ণ ও বাস্তবায়নে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রকৌশলী সমাজের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সেই ভূমিকায় পূর্ণ পারঙ্গমতা অর্জনের জন্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল ও প্রযুক্তির একটা বড় উৎকর্ষ কেন্দ্র হতে পারে, যেন আন্তর্জাতিক মানের কঠিনতম পরীক্ষায় অনায়াসে সেই শিক্ষাঙ্গন উত্তীর্ণ হতে পারে।
আমাদের দেশে প্রতিভার কাঁচা সোনার অভাব নেই। শুধু ঢাকার ধোলাইখালে নয়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে উদ্যোগী কারিগররা অত্যন্ত কষ্টকর পরিস্থিতির মধ্যে দেশের নানা ধরনের যন্ত্রপাতি ও কলকব্জার চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে। তাঁদের ওপর দৃষ্টি পড়েছে বিদেশি গবেষকদের। এখন আমাদের তাঁদের প্রতি অনুকূল দৃষ্টি দিতে হবে।
স্বাস্থ্য তথ্যের উন্নতি, জীবনদায়ী শুদ্ধ চিকিৎসার উন্নততর প্রযুক্তি ও প্রকৌশল, মস্তিষ্কের রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং, পারমাণবিক সন্ত্রাস দূরীকরণ, সাইবার স্পেসের নিরাপত্তাদান, ভার্চুয়াল রিয়ালিটি শক্তিশালীকরণ, ব্যক্তিগত জ্ঞানান্বেষণের বিস্তার উন্নয়ন এবং বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সাজ-সরঞ্জামের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন_এসব ব্যাপার আমার অধিগত নয়। আমরা সহসা বা অতিদ্রুত এই সমস্যার মোকাবিলা করার মতো সাহস ও সামর্থ্য রাখি না। আমি বলতে চাই, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যথেষ্ট বিষ আছে। আগে যখন তামার পয়সা ছিল, তখন একটা কথা ছিল তামার বিষ। বিজ্ঞান প্রযুক্তি মানবকল্যাণে কতখানি বিষমুক্ত করা যায়, সেই চিন্তা আমাদের অনুক্ষণ স্মরণে রাখা দরকার।
সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল একাডেমী মার্কিন ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের অনুরোধে পৃথিবীর নেতৃস্থানীয় প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানীদের মতামত গ্রহণ করে মানবসমাজের ১৪টি চ্যালেঞ্জকে চিহ্নিত করে। পৃথিবী ও মানুষের সাহায্যে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের অনুশীলনে কী কী অর্জন করা যায় এবং সেই অর্জন কিভাবে টেকসই করা যায়, সে সম্পর্কে মতামত গ্রহণ করে ৫০টি বিষয় বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পুনর্বিবেচনা করা হয়। সৌর জ্বালানি সাশ্রয়করণ, ফিউশন থেকে জ্বালানি সংগ্রহ, জীবাশ্ম জ্বালানি দহনজনিত কার্বন ডাই-অঙ্াইড সংগ্রহ করে পরিবেশের সংরক্ষণের জন্য জব্দ ও মজুদ করা, নাইট্রোজেন ব্যবস্থাপনা, সুপেয় জলের সন্ধান, নগর স্থাপনার উন্নয়ন প্রয়োজন।
সৌর জ্বালানি বা পারমাণবিক জ্বালানির প্রকৌশলগত সমাধান প্রযুক্তিগতভাবে যেন ফসিল জ্বালানির চেয়ে আর্থিকভাবে সাশ্রয়ী হয়, সেদিকে আমাদের লক্ষ রাখতে হবে। সৌরশক্তি ব্যবহারযোগ্য করতে ন্যানোটেকনোলজি আমাদের কিভাবে সাহায্য করবে, আমরা এখনো জানি না। তাত্তি্বক মহলে ফিউশন ব্যবহার করার কথা উঠেছে। সূর্যের জ্বালানির উৎস ফিউশন। তবে মানবসমাজে ফিউশন পদ্ধতিতে জ্বালানি সংগ্রহ করা একটা বিরাট চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। আমি সামান্য মানবিকবিদ্যার জ্ঞান নিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা করলাম, যা বিস্তারিতভাবে আমার পক্ষে আলোচনা করা অসম্ভব। আমাদের দরিদ্র দেশে সব বৈজ্ঞানিক ও প্রকৌশলী তত্ত্ব কাজে লাগানো বেশ সমস্যাসংকুল। আমরা যাতে একেবারে পশ্চাৎপদ ও আনপড় হয়ে না পড়ি, তার জন্য মোটামুটিভাবে তত্ত্বগুলো আমাদের জেনে রাখতে হবে, তাৎক্ষণিকভাবে তার কোনো প্রয়োগ না করতে পারলেও।
প্রকৌশলীরা সভ্যতার আলোকবর্তিকা-বাহক। সমাজে তাঁদের অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা মনে রেখে আমাদের নীতিশাস্ত্রে ও মানবিকবিদ্যায় অবশ্যই কিছু পাঠ নিতে হবে। দেশের বিরাজমান নৈতিক আবহাওয়ায় আমাদের স্বার্থের সংঘাত সম্পর্কে কিছু পরিষ্কার ধারণা থাকা উচিত।
বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতা থাকতে হবে। শিক্ষকদের স্বাধীনতা নাগরিক স্বাধীনতার চেয়ে বড়। শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ভোটাধিকার আছে। সুতরাং তাঁদের রাজনীতি করার স্বাধীনতা থাকবে না, তা বলা যায় না। তবে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সুস্থ প্রতিযোগিতার ধারণা হারিয়ে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ ক্লেদাক্ত হয়ে যেতে পারে। ক্যাম্পাসে এমন সব অপরাধকর্ম সংঘটিত হতে দেখছি যে আমরা অসহায় হয়ে কঠোরতম আইনের কথা বলছি। বলাবাহুল্য, ক্যাম্পাসকে জেলখানা বানানো যায় না। যারা অপরাধ করছে তাদের বিচার করে জেলে পোরা উচিত। মুষ্টিমেয় দুর্বৃত্তের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা বিনষ্ট করা যায় না। দেশের স্বার্থ শিক্ষার ওপর নির্ভরশীল এবং তার ভিত্তিমূলকে আমাদের প্রাণবান ও উদ্দীপনাময় রাখতে হবে।
তরুণ বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের মধ্যে জগদীশ বসু, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, কুদরাত-এ-খুদার মতো মেধাবী পুরুষ লুকিয়ে থাকতে পারেন। উচ্চ অট্টালিকাবিশারদ এফ আর খান এ দেশের সন্তান। ড. আবুল হুমসাম ও ডা. এ কে এম মুনির আর্সেনিক রোধে যুগান্তকারী সেনোফিল্টার আবিষ্কার করেছেন। পৃথিবীতে বাংলাদেশের যেসব পণ্ডিত, বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী ছড়িয়ে আছেন, তাঁদের নাম-ঠিকানা দিয়ে একটা তালিকা করা প্রয়োজন। আজ দেশের ভেতর এবং দেশের বাইরে যেসব তরুণ উদ্যোগী রয়েছেন, তাঁদের সবাইকে আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। আমাদের বড় করে ভাবতে হবে এবং আমাদের বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের সেবা গ্রহণের জন্য তৎপর হতে হবে, যাতে করে প্রয়োজনে আমরা তাঁদের সাহায্য নিতে পারি এবং তাঁদের সহায়তা দান করতে পারি।
উন্নয়ন অবিমিশ্র আশীর্বাদ নয়। বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট উন্নয়ন ও এক ভয়াবহ অভিশাপ বয়ে আনতে পারে। উন্নয়নের নেশায় যেন আমাদের দিগভ্রম না হয়। আমাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ের সঙ্গে মানবিকবিদ্যার কিছু সবক নিতে হবে। দেশের আইন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সবারই কিছু প্রাথমিক জ্ঞান থাকা দরকার। প্রকৌশলী ও প্রযুক্তবিদদের লাগাতার শিক্ষায় আজ কবিতারও স্থান রয়েছে।
তেল কম্পানি ঠেকায় পড়ে নৃতত্ত্ববিদের আশ্রয় নেয়। সুস্থ সমাজ চেতনায় দেশের বিরাজমান বৈষম্যকে হ্রাস করার একটা প্রণোদনা থাকতে হবে। সাম্প্রতিককালে আমরা দেখেছি, বৈষম্যপীড়িত ক্ষুব্ধ প্রজা কী ধরনের প্রবল আকার ধারণ করতে পারে। আমাদের সন্ত্রাস পরিহার করতে হবে এবং সেই উদ্দেশ্যে উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক বৈষম্য যাতে বৃদ্ধি না পায়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
লেখক : সাবেক প্রধান বিচারপতি ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.